ব্যাংক ডিপোজিটের প্রকারভেদ ও তার শরয়ী বিধান

 মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.


ব্যাংকিং পরিভাষায় ব্যাংক ডিপোজিট চার প্রকার:

১. কারেন্ট একাউন্ট (Current Account) বা চলতি হিসাব।
২. সেভিংস একাউন্ট (Savings Account ) বা সঞ্চয়ী হিসাব।
৩. ফিক্সড একাউন্ট (Fixed Deposit) বা নির্ধারিত মেয়াদি সঞ্চয়।
৪.লকার (Locker) তথা ব্যাংক থেকে লোহার বক্স ভাড়া নিয়ে তাতে টাকা পয়সা বা মূল্যবান সামগ্রী রেখে তা ব্যাংকের নিকট আমানত রাখা। (ফিকহী মাকালাত ৩/১৩-১৫)

ব্যাংক ডিপোজিটগুলোর শরয়ী অবস্থান:

প্রথম তিন প্রকার করজের হুকুমে দুটি শর্তের কারণে:

এক. এই তিন প্রকারের (কারেন্ট, সেভিংস ও ফিক্সড) ডিপোজিটারগণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে তাদের অর্থের যামিন বা জিম্মাদার বানায়।

দুই. ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে তাদের গচ্ছিত অর্থের যথেচ্ছা ব্যবহারের সার্বিক ক্ষমতা প্রদান করে থাকে।

চতুর্থ প্রকার তথা লকার (Locker) এটা বর্তমান প্রচলন ও শরয়ী দৃষ্টিকোণ উভয় বিবেচনায় আমানত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। (ফিকহী মাকালাত ৩/১৮)

সাধারণ ব্যাংগুলোতে অর্থ রাখার শরয়ী হুকুম:

১. জান ও মালের নিরাপত্তার খাতিরে কারেন্ট একাউন্টে টাকা রাখা জায়িয আছে। যেহেতু কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডারদেরকে ব্যাংক কর্তৃক কোন মুনাফা প্রদান করা হয় না। বরং তাদের থেকে উল্টা সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য চার্জ কাটা হয়। অতএব, কারেন্ট একাউন্টে টাকা রাখলে সুদি লেন-দেনে অংশগ্রহণ গণ্য হবে না। সুতরাং তা জায়িয আছে।

২.ফিক্সড ডিপোজিট ও সেভিংস একাউন্টে টাকা রাখা জায়িয নেই। কারণ এই উভয় প্রকার একাউন্ট হোল্ডারদেরকে ব্যাংক কর্তৃক মুনাফা প্রদান করা হয় এবং এই উভয় একাউন্টে গচ্ছিত টাকা উম্মতের ঐক্যমতে করজের হুকুমে। আর করজের বিনিময়ে লাভ হাসিল করা শরীয়তে সুদ। অতএব ব্যাংক একাউন্ট হোল্ডারদেরকে মূল টাকার অতিরিক্ত যে টাকাই প্রদান করবে তা স্পষ্ট সুদ হবে। আর সুদ বৈধ হওয়ার কোন সুরত নেই।

সুতরাং যে ব্যক্তি উল্লেখিত একাউন্টে টাকা রাখবে সে ব্যাংকের সাথে হারাম লেন-দেনে শরীক হয়ে যাবে। এ কারণে কোন মুসলমানের জন্য এই দুই প্রকার (সেভিংস এবং ফিক্সড ডিপোজিট) একাউন্টে টাকা রাখা জায়িয নেই । কেউ রেখে থাকলে সুযোগ থাকলে সে একাউন্ট পরিবর্তন করে চলতি হিসাব খুলে সেখানে টাকা রাখবে। আর যদি কোন কারণে চলতি হিসাব খুলতে অপারগ হয় এবং জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য সেভিংস একাউন্ট খুলতে বা জারী রাখতে বাধ্য হয়, তাহলে সে ইস্তিগফার করতে থাকবে এবং ঐ একাউন্টে যে সুদ আসবে তা সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া মিসকিনদেরকে বা মসজিদ মাদরাসার বাথরুম নির্মাণের জন্য (কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে) দিয়ে দিবে।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর হুকুম:

ইসলামী ব্যাংক একটি মহত উদ্যোগ। উদ্যোক্তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই। যদি এটিকে তারা পূর্ণ ইসলাম অনুযায়ী পরিচালনা করেন। যার জন্য জরুরী হলো;

(ক) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই মর্মে অনুমতি না নিয়ে থাকলে অনুমতি নিবে যে, ব্যাংক সরাসরি নিজে বাণিজ্যিক মাল আমদানি ও রপ্তানি করবে।

(খ) প্রত্যেক শাখার কারবার প্রত্যক্ষ করার জন্য একজন বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন থাকবে এবং সর্বময় কর্তৃত্ব ম্যানেজারের নয়, মজলিসে শূরার হাতে থাকবে। (ইসলাম আওড় জাদীদ মায়ীশাত পৃ. ১২৬)

১. ইসলামী ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্ট সাধারণ ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্টের মত জায়িয আছে।

২. ইসলামী ব্যাংকগুলো সেভিংস এবং ফিক্সড ডিপোজিটারদের সাথে টাকা বিনিয়োগের বিভিন্ন ব্যবসায়িক খাত দেখিয়ে যে চুক্তি করে থাকে তাকে শরিয়তের পরিভাষায় আকদে মুযারাবাহ বলে। আর ডিপোজিটারদের পরস্পরের মাঝে হয় আকদে মুশারাকাহ বা অংশীদারিত্বের চুক্তি। যারা সকলে মিলে তাদের অর্থ ও শ্রম ব্যাংকের নিকট সোপর্দ করেছে লাভ-লোকসানের মধ্যে শরীক হওয়ার ভিত্তিতে। ব্যাংক তাদেরকে নির্দিষ্ট পার্সেন্টিজ হিসেবে লাভ দিবে। আর ক্ষতি হলে মুনাফা দ্বারা তা পূরণ করা সম্ভব না হলে ডিপোজিটারকেও তার অংশ অনুপাতে লোকসানের বোঝা নিতে হবে। বাস্তবে এমনটি হলে তা জায়িয হবে। কিন্তু সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদী ব্যাংকগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে সুদী লেন-দেনের সাথেই বেশী জড়িত। তারা মুখে মুখে হালাল মুনাফা প্রদানের কথা বললেও সহীহ তরীকায় ইনভেস্ট করে না তথা বেচা-কেনার মধ্যে শরীয়ত যে-সব শর্ত আরোপ করেছে তা সঠিকভাবে রক্ষা করে না। খাতা কলমে ঠিক দেখালেও বাস্তবে করে খামখেয়ালী এবং জনবল না থাকার দোহাই দিয়ে থাকে যা অগ্রহণযোগ্য।

তাই প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলোতেও সেভিংস এবং ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্ট খোলা জায়িয হবে না। যতক্ষণ না তারা তাদের কার্যক্রম বাস্তব ক্ষেত্রেও শরয়ী পন্থায় নিয়ে আসে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতায় তাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ শরীয়ত ভিত্তিক প্রমাণ করতে না পারে। (আল মাবসূত লিস্ সারাখসী ২২/১৩৩)

অমুসলিম দেশের ব্যাংকের হুকুম:

অমুসলিম দেশের অমুসলিম মালিকদের ব্যাংক কর্তৃক প্রদেয় সুদ গ্রহণের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের সমর্থন রয়েছে। যেহেতু তারা এই টাকা মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে দুর্বল করার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে। কাজেই সূদের টাকা ব্যাংকে না ছেড়ে উঠিয়ে নিবে। তার পর সাওয়াবের নিয়ত না করে মিসকিনদেরকে দিয়ে দিবে। (ফিকহী মাকালাত ৩/২২)

সুদী টাকার হুকুম:

যারা শরয়ী বিধান না জানার কারণে শরীয়ত বিরোধী পন্থায় লেন-দেন করার কারণে কিছু সুদী টাকা তার মালিকানায় চলে এসেছে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শরী‘আতের বিধি-বিধানের পাবন্দি ছিলনা। কিন্তু এখন সে তাওবা করে সুদ থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে, তারা সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া ঐ টাকা ফকীর-মিসকিন অথবা কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করে দিবে। (ফিকহী মাকালাত ৩/২২)

One thought on “ব্যাংক ডিপোজিটের প্রকারভেদ ও তার শরয়ী বিধান

  1. যারা ব্যাংকে চাকরি করে তাদের কি বেতন হালাল হবে????

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.