আত্মহত্যা প্রবণতা, উৎস ও কারণ: আমাদের দায়বদ্ধতা

হযরত নেসার আহমাদ কাসেমী | সেক্রেটারি জেনারেল, একাডেমী অব রিসার্চ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, হায়দ্রাবাদ

মুসলিম উম্মাহ তার সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় অনেক উত্থানপতন অতিক্রম করেছে। প্রত্যক্ষ করেছে অসংখ্য চড়াই-উতরাই। যুগে যুগে মোকাবেলা করেছে নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাক আর শত শত সমস্যা ও প্রতিকূলতা। যে কোন জাতি বা সম্প্রদায় সবচে বড় বিপর্যয় ও হুমকির সম্মুখীন তখনই হয় যখন তাদেরকে হতাশা ও নিরাশার অন্ধকার ঘিরে ধরে। যখন তাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, তাদের বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায় এবং তাদের মন মস্তিষ্কে জেঁকে বসে সব রকম দুঃখ-দুর্দশা, অসহায়তা, অক্ষমতা, অধঃপতন ও বরবাদির অনুভূতি।

মানুষ যখন হতাশার শিকার হয়, তখন তার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রদীপগুলো একে একে নিভে যায়। ধীরে ধীরে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সে হন্য হয়ে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তির কোন উপায় খুঁজতে থাকে। তারপর এক সময় সর্বশেষ উপায় হিসেবে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিজাতীয় ও ভিন্নধর্মীয় সমাজগুলোর মতো মুসলিম সমাজেও এই ব্যাধি ব্যাপক আকার ধারণ করে চলেছে। অন্যান্য জাতি ও ধর্মাবলম্বীদের মতো মুসলমানরাও এই জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।

সাধারণত যারা আত্মহননের পথ বেছে নেয় এবং নিজের জীবন বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হয়, আত্মহত্যার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে তাদের মাঝে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যে বিষয়গুলো তার আশপাশে থাকা নিকটজনদের লক্ষ্য রাখা উচিৎ এবং পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা উপলব্ধি করে তার সংশোধনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিৎ।

উদাহরণ স্বরূপ, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি হতাশা ও গ্লানির শিকার হয়ে থাকে। সবসময় হতাশাজনক কথাবার্তা বলে। সারাক্ষণই তাকে বিষণ্ণ, উদ্বিগ্ন, ভারাক্রান্ত, ব্যথিত এবং সব বিষয়ে উৎসাহশূন্য দেখা যায়। সে বারবার নিজের অক্ষমতা, অপারগতা আর দুর্ভাগ্য-দুর্দশার অভিযোগ করতে থাকে। সব ধরনের অপূর্ণতা ও শূন্যতার হাহাকার তাকে অস্থির করে তোলে।

তারপর এক সময় হঠাৎ করেই তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন দেখা দেয়। তার ওঠা-বসা, মানুষের সাথে মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া, ঘুম ও জাগ্রত অবস্থা, মোটকথা তার যাবতীয় কাজকর্মের সময় ও ধরন বদলে যায়। সে নিজের পোশাক-আশাকের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। সামাজিক সম্পর্কগুলো এড়িয়ে চলতে চায়। বিভিন্ন রকম অদ্ভুত অদ্ভুত উপায়ে সে মৃত্যুর কথা আলোচনা করে। প্রতিদিনের কর্মচঞ্চল জীবন থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে।

যে সমস্ত কাজ ও বিষয় তার খুবই পছন্দের এবং ভালোলাগার বিষয় ছিলো; এখন সে আর এগুলোতে কোনো আনন্দ ও উৎসাহ খুঁজে পায় না। সে নির্জনতাপ্রিয় হয়ে যায়। একাকী থাকতে পছন্দ করে। সমাজ ও সমাজের মানুষগুলোকে সে একরকম ঘৃণা করতে শুরু করে। কখনো সে মাথাব্যথার অভিযোগ তোলে। কখনো মূর্ছা যায়। কখনো বা নিজের দামি দামি জিনিসপত্রগুলো ভেঙ্গে চুরে একাকার করে ফেলে। সে তার শখের জিনিসগুলো, যা সে খুব কষ্ট করে সংগ্রহ করেছিলো, নষ্ট করতে থাকে।

তারপর আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্যে আসক্ত হয়ে যায় সে। তখন সে সাংঘাতিক বিপদাপদের বিষয় নিয়েও খেলতে কোন পরোয়া করে না। কখনো সে অত্যন্ত উঁচু জায়গা থেকে লাফিয়ে পড়ে! আবার কখনো ব্যস্ততম মহাসড়কে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলা গাড়ির মাঝেই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে!!

তার অতি প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধপত্র অথবা পূর্ব থেকেই যেসব ওষুধ সে খেতো, সেগুলো এড়িয়ে চলতে চায় অথবা ওষুধপত্র খেতে সরাসরি অস্বীকার জানায়। এভাবে চলতে চলতে একসময় সে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। প্রথম প্রথম তার চেষ্টাটা ততটা সিরিয়াস হয় না। তাই সে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সফল হতে পারে না। কিন্তু এরপর তার মধ্যে দৃঢ়তা চলে আসে এবং এবার সে আত্মহত্যায় সফল হয়ে যায়।

উল্লেখিত লক্ষণগুলো যখন কারো মাঝে পরিলক্ষিত হয় তখন তার মা বাবা, স্বামী বা স্ত্রী অথবা তার নিকটজনদের তার ব্যাপারে স্পষ্ট বিপদাশঙ্কা করা উচিৎ। তাকে এই ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিৎ এবং তার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

সাধারণত যারা মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত কিংবা মস্তিষ্কের সমস্যায় আক্রান্ত তারা সবসময় বিভিন্ন উপায়ে নিজেরাই নিজেদের কষ্ট দিতে থাকে। কখনো দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠুকতে থাকে। কখনো হাত ভেঙ্গে ফেলে। কখনো কান ফুড়ে ফেলে। এভাবে অনবরত কোনো না কোনো উপায়ে নিজেকে কষ্ট দিতেই থাকে। আর এ জাতীয় বিষয়গুলো খিঁচুনির আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। কথায় কথায় চিৎকার-চেঁচামেচি করা, নিজেই নিজেকে আঘাত করতে থাকা। কখনো কাঁদা, কখনো হাসা, এই বিষয়গুলো হলো আত্মহত্যা-পূর্ববর্তী ধাপ। এক্ষেত্রে মা-বাবা ও অভিভাবকদের দায়িত্ব হচ্ছে, বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেয়া এবং কোনরূপ অলসতা, অবহেলা না করে অনতিবিলম্বে কোনো অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে সাক্ষাত করা। কারণ, এই বিষয়গুলোই প্রাক-আত্মহত্যা উপসর্গ এবং আত্মহত্যার প্রাথমিক পর্যায়।

সমাজ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীগণ লিখেছেন, শতকরা ৩৫ ভাগ আত্মহত্যার উৎস মস্তিষ্কবিকৃতি কিংবা মানসিক রোগ। যেমন, হতাশা, ব্যর্থতা, বিরহ-বিচ্ছেদ, একাকীত্ব, বেকারত্ব এবং মাত্রাতিরিক্ত মদপান বা অন্য নেশাদ্রব্যের ব্যবহার। আর বাকি ৬৫ ভাগ আত্মহত্যার কারণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, ভুল শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতিগত ভারসাম্যহীনতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, কারো প্রতি অত্যধিক আবেগতাড়িত হয়ে তারপর একেবারে নিরাশ হয়ে যাওয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে কিংবা পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দীর্ঘ শারীরিক অসুস্থতা ও ভোগান্তি অথবা কোন লজ্জা, অপমান ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয়।

এই সমস্ত সমস্যায় জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও যদি কারো মাঝে সঠিক দ্বীনী শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ থাকে তবে সে নিজেকে আত্মহত্যা হতে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আর যখন কারো মাঝে সঠিক দ্বীনী শিক্ষা না থাকে কিংবা এর অভাব থাকে; তখন সে এই জঘন্যতম কাজের ভয়াবহতা এবং এই মহা অপরাধের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। ফলে সে দুনিয়াতে নিজেকে ‘জীবনের অধিকার’ থেকে বঞ্চিত করে এবং আখিরাতের অনন্ত জীবনেও নিজেকে ভয়ানক শাস্তি ও কঠোর সাজার উপযুক্ত বানিয়ে নেয়।

মানুষ যখন সাচ্চা ঈমানের অধিকারী হয় তখন আল্লাহ তাআলার ওপর তার ইয়াকিন ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়। সে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার ফায়সালার প্রতি রাজি-খুশী থাকে। ‘তাক্বদীরের’ ওপর অভিযোগ উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। তার পক্ষে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক না কেন, যত দুঃখ-কষ্টই তার ওপর নেমে আসুক না কেন, আল্লাহ তাআলার ওপর তার অবিচল আস্থা ও ভরসায় বিন্দুমাত্র চিড় ধরে না। কারণ সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, আত্মহত্যা তার সমস্যার কোন সমাধান হতে পারে না। সে আরো বিশ্বাস করে, তাকদীরকে বদলে ফেলার ক্ষমতাও তার হাতে নেই আর পরিস্থিতি পরিবর্তন করার শক্তিও তার কাছে নেই। সবকিছুর ক্ষমতা কেবল বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার কুদরতী হাতেই রয়েছে।

অপরদিকে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি এই ভ্রান্ত ধারণা করে, সে যে কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, যে দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যা-সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আত্মহত্যা করেই সে এর অবসান ঘটাবে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভ করে চির সফলকাম হয়ে যাবে। যা মূলত সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, ভুল ও অবাস্তব ধারণা। দ্বীনের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণেই সে এই ভুল ধারণার শিকার হয়ে থাকে।

 

আত্মহত্যার কারণসমূহ

আত্মহত্যার মৌলিক কারণ

আত্মহত্যার মৌলিক কারণ হলো, ধৈর্য ও সহ্যশক্তি না থাকা। ধীরস্থিরতার অভাব। ফলে অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেই সে ভীষণ উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে যায়। হতাশা ও নিরাশার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে। বিভিন্ন রকম বিপদাশঙ্কা, উৎকণ্ঠা ও কুমন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে এক সময় আত্মহননের পথে পা বাড়ায়।

অর্থনৈতিক সংকট

আত্মহত্যার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। যেমন দারিদ্র, বেকারত্ব, অনেক অনেক ডিগ্রি এবং উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পাওয়া। চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া। সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘ লকডাউনে যেমনটি ঘটেছে। অসংখ্য লোক অভাবের তাড়নায় পুরো পরিবার সহ আত্মহত্যা করেছে। অতি সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো যে, বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পেতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা গেল যে, বাস্তবিক অর্থেই আত্মহত্যার হার যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। খোদ মুসলমানদের মাঝেও এর প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে।

মিডিয়ার কুপ্রভাব

সাম্প্রতিককালে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, মিডিয়ার লাগামহীন শ্লীল-অশ্লীল নানান বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপিত বিভিন্ন রঙ্গের চিন্তা-চেতনা। এগুলো দেখে দেখে মানুষ মিডিয়ার তথাকথিত সেলিব্রেটিদের অনুকরণের চেষ্টা করে এবং মনের অজান্তেই নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের প্রভাবকে অনিবার্যরূপে গ্রহণ করতে থাকে। এভাবে এক পর্যায়ে সে আত্মপরিচয়ই হারিয়ে বসে, কিন্তু তারপরও সে তাদের মতো হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে হতাশার জালে আটকা পড়ে যায়।

পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতা

পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বংশগত বিদ্বেষ, ঘরোয়া সমস্যা ও জটিলতাও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। যেমন বাবা মা কিংবা বংশের অন্য সদস্যদের মাঝে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা ঝগড়া-বিবাদ। ছোট ছোট শিশুরা যখন সৎ মা অথবা সৎ বাবার আশ্রয়ে থাকে তখন সেই শিশুদের সাথে কঠোর আচরণ করা হয়, তাদের সাথে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করা হয়। তাদেরকে শারীরিক মানসিকভাবে কষ্ট দেয়া হয়। তাদেরকে স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাদের শারীরিক মানসিক প্রয়োজন ও চাহিদা উপেক্ষা করা হয়। সবসময় তাদেরকে তিরস্কার করা হয়, অভিশাপ দেয়া হয়। তাদের নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা হয়। সর্বোপরি তাদের আবেগ-অনুভূতির অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এই সকল শিশুদের মাঝে হতাশা ও বঞ্চনার একটি তীব্র মানসিকতা সৃষ্টি হয়; যা তাদেরকে জীবন বিসর্জন দিতে এবং আত্মহত্যা করার দিকে ঠেলে দেয়।

ব্যর্থতা

আত্মহত্যার আরো একটি কারণ ব্যর্থতা। সেটা যে কোন ক্ষেত্রের ব্যর্থতাই হোক না কেন। যখন কেউ গভীর প্রেমে পড়ে, তারপর সেই প্রেমে ব্যর্থ হয়, তখন সে আত্মহত্যা করে বসে। কখনো আর্থিক ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়। কখনো ঋণ আদায় করতে বা অন্যান্য অপরিহার্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অর্থ যোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। অথবা ব্যবসায়িক কারবারে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, পরীক্ষায় ফেল করে। অত্যন্ত ভালো কোন চাকরি থেকে বরখাস্ত হয় তখন বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এমনকি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে, বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ আত্মহত্যা বিভিন্ন রকম ব্যর্থতার কারণেই ঘটে।

নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব

আত্মহত্যার অন্যতম আরেকটি কারণ নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব। কখনো নিজের কৃত কোন অপরাধের শাস্তির অপমান ও লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার জন্যে মানুষ আত্মহত্যা করে বসে। কখনো কেউ এমন কোন পাপকাজে জড়িয়ে পড়ে; যা মানুষের উপহাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সে নিজেকে শাস্তি দেয়া উদ্দেশ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কখনো কেউ আবার নিঃসঙ্গতা বোধের কষ্ট ভুগতে থাকে। সে ভাবে যে, পৃথিবীর এই বিপুল জনরাণ্যের মাঝে সে নিতান্তই একা। তার প্রকৃত কাছের মানুষ বলতে কেউ নেই। কেউ তাকে বুঝতে চায় না। কেউ তার ব্যথা-বেদনা অনুভব করতে পারে না। সে ভাবতে থাকে, সমাজের মানুষজন তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তার ব্যাপারে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।

সে যেহেতু অন্যদের ওপর ক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে শাস্তি দিতে পারছে না তাই অবশেষে নিজেকেই শাস্তি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এ বিষয়গুলো সাধারণত তাদের মাঝেই দেখা দেয়; যারা সব সময় নেতিবাচক মানসিকতায় ভোগে, অথবা যারা মানসিক অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠার শিকার, কিংবা মস্তিষ্কের সমস্যায় আক্রান্ত।

দুরারোগ্য ব্যাধি

আত্মহত্যার অন্যতম বড় একটি কারণ হচ্ছে জটিল কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া। এমন কোন অসুস্থতা; যা থেকে সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। যেমন ক্যান্সার, এইডস, কুষ্ঠরোগ বা এ জাতীয় রোগ। এই সমস্ত রোগে আক্রান্ত রোগীরা রোগের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কিংবা বেঁচে থাকার ব্যাপারে এক রকম নিরাশ হয়ে গিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, এ জাতীয় রোগের কারণে আত্মহত্যার আনুপাতিক হার ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ, অপরদিকে মাত্রাতিরিক্ত মদপান বা অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্যে আসক্তির কারণে আত্মহত্যার হার ১৫ শতাংশ।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

নিঃসন্দেহে এটি একটি ভয়াবহ বিপজ্জনক প্রবণতা। যা সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি করে এবং সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে। অত্যন্ত আফসোস ও পরিতাপের বিষয় এই যে, ইদানীং মুসলিম দেশগুলোতেও দিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণ মূলত নিজেদের দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়া, ইসলামী হিদায়াতের ব্যাপারে জ্ঞান-শূন্যতা এবং দ্বীন-ধর্মের বুনিয়াদি শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা ও অপরিচিতি। সুতরাং ওলামায়ে কেরাম, দ্বীনের দাঈগণের পাশাপাশি ইসলামী সংগঠন, বিভিন্ন দল-উপদল এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে তারা জনসাধারণের মাঝে ‘ঈমানী চেতনার’ জাগরণ সৃষ্টি করবে। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক জুড়ে দিয়ে তা দৃঢ় থেকে সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালাবে।

তাদের মাঝে এই অনুভূতি জাগ্রত করবে যে, হতাশা ও নিরাশা হচ্ছে কুফরের অন্ধকার। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, মানুষের উচিৎ সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহ তাআলারই ওপর ভরসা করা। কারণ, তিনিই দারিদ্র দিয়ে থাকেন, সচ্ছলতাও তিনিই দান করেন। তিনিই সাফল্য ও ব্যর্থতা, সুস্থতা ও অসুস্থতার মালিক। মান-সম্মান ও অপমান, উত্থান-পতন, উন্নতি-অবনতি সবকিছুই তাঁরই কুদরতি হাতে রয়েছে।

সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার কাছেই নিজের সব প্রয়োজন এবং সমস্যা-সংকটের উত্তরণ চাওয়া উচিৎ। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য সংকট উত্তরণের কোন পথ তৈরি করে দেন (অর্থাৎ আল্লাহ তাআলাই তার সমস্যা সমাধানকারী হয়ে যান)। আর তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক দান করেন, যা তার ধারণার বাইরে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে; আল্লাহ তাআলাই তার (সব কাজ সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ তাআলা তাঁর কাজ পরিপূর্ণ করবেনই। সবকিছুর জন্য আল্লাহ তাআলা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে রেখেছেন। (সূরা তালাক, ১-৩)

ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়া সেইসব মুসলমানদের বোঝানো দরকার যে, আত্মহত্যা কিছুতেই বিপদাপদ, সমস্যা-সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে না। বরং তা পরিত্রাণের বদলে আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য দুঃখ-কষ্ট, এবং কঠিন শাস্তির কারণ। তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার অভিমুখী হয়ে তাঁর আদেশের আনুগত্য করা উচিৎ। তাক্বদীরের ওপর সন্তুষ্ট থেকে তাঁর ফায়সালার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা উচিৎ।

ভাষান্তর: মুশফিক ইলাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *