শিক্ষণীয় ঘটনা : হারিয়ে যাওয়া চার যুবক ও তাকদীর

অনেক দিন আগের কাহিনী।  চার এলাকায় বাস করতো চারজন যুবক। তাদের জীবনে তারা এক বার চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় এবং চারজনই জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। অবশেষে বাড়ী ঘর ত্যাগ করে তারা পথে নেমে পড়ে।  উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে কুদরত তাদের চারজনকেই এক সূত্রে যুক্ত করে দেয়। তাদের কারো নিকট পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত অন্য কিছুই ছিলো না। কারণ, চারজনই বাড়ী ত্যাগ করেছে রাগ করে, অভিভাবকের অজান্তে। এ জন্য তারা চরম অভাব ও কষ্টে নিপতিত হলো। চলতে চলতে তারা মাতরুন নামক একটি শহরের নিকটবর্তী হলে তাদের মধ্য থেকে একজন সবাইকে থামতে বলল। ক্ষুধায় ও দুর্বলতায় তখন দশদিক আঁধার, সে বলল, শোন বন্ধুরা এভাবে গন্তব্যহীন হেঁটে কোন লাভ নেই। আমাদের গন্তব্য ও কর্মপন্থা কী হবে সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। এসো আমরা অর্থহীন ঘোরাফেরা না করে ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছি। সকলেই তার কথায় একমত পোষণ করে বলল চলো আমরা ঐ ছায়াদার বৃক্ষের নীচে বসি। এমনিতেই আমরা ক্ষুধায় কাতর ও ক্লান্ত। তারা রাস্তার পাশে বৃক্ষের নীচে বসে পড়লো। এরপর প্রত্যেকেই প্রথমে নিজ পরিচয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরল।

প্রথমজন বলল : আমি ফাবিরান রাজ্যের রাজকুমার। আমার পিতা কিছু দিন হলো দেহত্যাগ করেছেন। আমার বিশ্বাস দুনিয়াতে সমস্ত কাজ তাকদীরের উপর নির্ভর করে। তাকদীরে সৃষ্টিকর্তা যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। তাকদীরকে বদলে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই। তাই তাকদীরে আস্থা রেখে সবর ইখতিয়ার করা এবং সুসময়ে অপেক্ষায় থাকা আমার মতে যুক্তিযুক্ত।

এবার মুখ খুলল সেই যুবক যে সাথীদের পরামর্শে বসতে আহবান করেছিল, বলল, আমি একজন ব্যবসায়ীর ছেলে। আমার ধারণা, জ্ঞান পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। জ্ঞানের বিকল্প কিছুই নেই। আর মানুষ যদি নিজ জ্ঞান দ্বারা বুদ্ধি খাটিয়ে কোন ব্যবসা করে, তবে তার কোন অভাবই থাকবে না।

এবার তৃতীয়জনের পালা সে ছিল অত্যন্ত সুদর্শন ও হৃদয়গ্রাহী অবয়বের অধিকারী। সে বলল, আমি একজন আমীরের ছেলে। তোমাদের কারো কথার সাথে আমি একমত নই। আমার মনে হয় সৌন্দর্যই সব কিছুর মূল। পৃথিবীতে সুন্দর জিনিসের মূল্য সব থেকে বেশি। আর মানুষ মাত্রই সৌন্দর্য প্রিয় তারা অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা জ্ঞান বুদ্ধির চেয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বেশি প্রাধান্য দেয়।

সবশেষে চতুর্থজন বলল, আমি কৃষকের ছেলে। তোমাদের সবার থেকে আমার কথা ভিন্ন। আমার মতে পরিশ্রম করে উপার্জনের চেয়ে উত্তম পৃথিবীতে অন্য কিছুই হতে পারে না। পরিশ্রমই উন্নতির সোপান। কৃষকপুত্রের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিন সাথী বলে উঠলো, তাহলে তুমি তোমার কথার প্রমাণ দাও, পরিশ্রম করে আজকের খাবারের ব্যবস্থা করো। আমরা এখানেই বসে থাকবো।

তাদের কথায় সম্মতি জানিয়ে কৃষকপুত্র শহরে চলে গেলো। সে জানতে চেষ্টা করল, স্থানীয় বাজারে কোন বস্তুর চাহিদা বেশি। জনৈক শহরবাসী জানালো এখানে জ্বালানী কাঠের চাহিদা বেশী। সে তথ্যানুযায়ী জঙ্গলে চলে গেলো। এক আটি জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করে, তা এক দিরহাম মূল্যে বিক্রি করে দিলো। ফেরার সময় শহরের ফটকে লিখে রাখলো। “একদিনের শ্রমের মূল্য এক দিরহাম”। এরপর দিরহামটি দিয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে সাথীদের নিকট ফিরে এলো। সাথীরা খেয়ে দেয়ে তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

এই দিনটা তো অতিবাহিত হয়ে গেলো। পরের দিন। সবাই বলল, আজ আমীর পুত্রের পালা। তাকে বলা হলো, যাও আজ তোমার সৌন্দর্যের কারিশমা দেখাও আর আমাদের খাবারের ইন্তেজাম করো।

আমীর পুত্র শহরের দিকে রওনা হয়ে গেলো। সে হাঁটছে আর ভাবছে- আমি তো কোন কাজ করতে পারি না। শহরে গিয়ে করবোটা কী? আর খাবার ছাড়া তো সাথীদের কাছে ফিরতে পারবো না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা না পেয়ে একটি বৃক্ষের নীচে বসে পড়লো। চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। একজন সম্ভ্রান্ত আমীর পাইক পেয়াদা নিয়ে সে পথ অতিক্রমকালে দৃষ্টি পড়লো যুবকটির উপর। হৃদয়গ্রাহী অবয়ব আর স্বর্গীয় রূপধারী যুবকটিকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ভাবলেন নিশ্চয়ই এ কোন সম্ভ্রান্ত বংশীয় আমীরের সন্তান হবে। হয়তো কোন বিপদে পড়ে সহায় সম্বল হারিয়ে অনাদরে অবহেলায় পড়ে আছে। তাকে সাহায্য করলে সে বাবা মায়ের নিকট ফিরে যেতে পারবে। যুবকটিকে ডেকে পাঁচশত দিরহাম হাতে দিয়ে বাড়ী ফেরার উপদেশ দিয়ে আমীর পা বাড়ালেন। পাঁচশ দিরহাম হাতে পেয়ে আমীর পুত্র শহরের ফটকে লিখে রাখলো “এক দিনের সৌন্দর্যের মূল্য পাঁচশত দিরহাম”। অতঃপর সে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করে আনন্দিত মনে সাথীদের নিকট গমন করলো। সাথীরা আমীর পুত্রের আমীরানা খাবার খেয়ে উদর পূর্তি করে ঘুমিয়ে পড়লো।

দ্বিতীয় দিনটি তারা আনন্দের সাথে অতিবাহিত করে তৃতীয় দিন সবাই ব্যবসায়ী পুত্রকে বলল, আজ তোমার জ্ঞান বুদ্ধির পরীক্ষা হবে। যাও বুদ্ধি খাঁটিয়ে ব্যবসা করে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করো। কথা মত ব্যবসায়ী পুত্র ব্যবসার উদ্দেশ্যে শহরের বাণিজ্য কেন্দ্রে উপস্থিত হলো। একে একে মানুষের চাহিদা মাফিক সমস্ত বস্তু সামগ্রীর খোঁজ খবর নিলো, সে দেখতে পেলো সমুদ্র উপকূলে একটি বাণিজ্য জাহাজ নোঙ্গর করেছে। তথায় উপস্থিত হয়ে শুনতে পেলো স্থানীয় বণিকরা জাহাজের এক কোনে পরামর্শে বসেছে। তারা বলেছে, এখন বাজারের পণ্যের দাম খুব চড়া, তাই আজ আমরা কিছুই ক্রয় করবো না। এর ফলে খুব দ্রুত মূল্য পতন শুরু হবে। আর আমরা স্বল্পমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারবো। যুবকটি সমস্ত কথা শুনে মনে মনে মতলব আঁটল। সে ভিন্ন রাস্তায় জাহাজে গমন করে সমস্ত পণ্য এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা মূল্যে বাকিতে কিনে নিল এবং অন্য এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ভান করল। বণিকদল অবস্থা দেখে প্রমাদ গুণলো। পণ্য হাত ছাড়া হতে দেখে একলক্ষ রৌপ্যমুদ্রা লাভে যুবকটির নিকট পণ্য কিনতে প্রস্তাব করলে সে সাথে সাথেই সম্মত হয়ে গেলো। ফলে মিনিটেই তার হাতে নগদ এক লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা এসে গেলো। সে প্রয়োজন মত খাদ্য দ্রব্য ক্রয় করে সাথীদের কাছে গেলো, ফেরার পথে প্রধান ফটকে লিখে রেখে গেলো “একদিনের জ্ঞানের মূল্য একলক্ষ রৌপ্য মুদ্রা।”

তিনটি দিন চার ভবঘুরের ভালোয় ভালোয় পার হয়ে গেলো। চতুর্থ দিন আইনগতভাবেই রাজকুমারের পালা। তাকে বলা হলো, যাও তোমার বিশ্বাসের ফল দেখাও। আজ আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করো। রাজকুমার শহর অভিমুখে রওনা হয়ে গেলো। প্রধান ফটকে পৌঁছে একটি বেঞ্চ পেয়ে তাতে বসে পড়লো। সে দেখতে পেলো- কারো শবদেহ নিয়ে জনতার বিশাল মিছিল প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে আসছে। ঘটনা হচ্ছে সেই দিনেই সে দেশের রাজার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। সবাই শোকে শোকাহত। রাজার কোন উত্তরসুরী নেই। প্রজারা সবাই কাঁদতে কাঁদতে জানাযায় অংশ নিতে দলে দলে শহরের বাইরে যাচ্ছিলো। ব্যতিক্রম শুধু রাজকুমার। সে চোখে মুখে আনমনা নির্বিকার ভাব নিয়ে বসে ছিলো। তার শোকতাপহীন উদাসীন ভঙ্গি দেখে দ্বাররক্ষী বলল, তুমি কে? কোত্থেকে এসেছো? রাজার মৃত্যু হয়ে গেছে আর তুমি একটুও ব্যথিত নও? যাও এখান থেকে! তাড়া খেয়ে রাজকুমার সরে গেলো, কিন্তু একটু পর এসে আগের স্থানে বসে পড়লো।

রাজার জানাযা সমাধা করে ফিরে এসে তাকে সেখানে আবার বসে থাকতে দেখে রক্ষী বলল, নিষেধ করা সত্ত্বেও আবার বসেছ! এরপর রাগান্বিত হয়ে তাকে বন্দী করলো।

পরদিন যখন রাজ্যের অমাত্যবর্গ রাজা নির্বাচনে বসল, তখন দেখা দিলো চরম বিশৃঙ্খলা। রাজা শূন্য রাজ্য যেমন হয় আরকি। সবাই সিংহাসনের দাবীদার। এক পর্যায়ে দ্বাররক্ষী বলল গতকাল আমি অভিজাত চেহারার এক যুবককে দেখেছি। সে আপনাদের মতো শোকাহত ছিলো না। চুপচাপ বসে ছিলো। প্রধান ফটকে আমার প্রশ্নে উত্তর না দেয়ায় তাকে স্থান ত্যাগ করতে বলি। সে চলে যায়। কিন্তু আবার এসে পূর্বের স্থানে বসে থাকে। আমি তাকে গুপ্তচর সন্দেহে আটক করে কারাগারে পাঠিয়ে দেই। তার চেহারায় ছিলো বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ছিলো রাজকীয় ভাব। যুবকটির কথা শুনে সবাই তাকে দেখতে আগ্রহী হলো। রাজকুমারকে উপস্থিত করতে নির্দেশ দেয়া হলো। তাকে রাজ দরবারে আনা হলে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো কে তুমি? কোথায় তোমার নিবাস? এ শহরেই বা কেন এসেছো?

রাজকুমার বলতে শুরু করলো- আমার দেশ ফাবিরান। আমার প্রয়াত পিতা সে অঞ্চলের রাজা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর আমার ভাই মসনদ দখল করে আমাকে প্রতিপক্ষ মনে করে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। আমি প্রাণ বাঁচাতে এ শহরে চলে এসেছি। রাজকুমারের বয়ান শুনে যারা ফাবিরান রাজ্যে গিয়েছিলো তারা পিতার ভূয়সী প্রশংসা করলো। সবাই যুবকটিকে নিজেদের জন্য খোদার রহমত জ্ঞান করলো। একজন বললো আমাদের রাজা নির্বাচনের মুহূর্তে এদেশে আপনার আগমন আল্লাহর রহমত বৈ কিছুই নয়। তিনি আপনাকে পাঠিয়ে এ রাজ্যে উত্থিত হতে যাওয়া নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়েছেন। ন্যায় বিচারক রাজার ছেলেই রাজা হওয়ার যোগ্য। তাই আমরা আপনাকে আমাদের রাজা নির্বাচিত করলাম।

এরপর এলো আনুষ্ঠানিকতার পর্ব। নবনির্বাচিত রাজাকে সফেদ হস্তিতে আরোহণ করিয়ে দেশীয় রেওয়াজ মোতাবেক শহরময় প্রদক্ষিণ শুরু হলো। এরপর এক পর্যায়ে রাজ বাহন প্রধান ফটকের নিকটবর্তী হলে রাজা ফটকের গায়ে তার পূর্বের তিন সাথীর তিনটি উক্তি লেখা দেখলেন। তিনিও তাদের মতো কিছু লিখতে মনস্থ করলেন। লেখককে ডেকে বললেন এই লেখা সমূহের পাশে এই বাক্যগুলো লিখে দাও। “পরিশ্রম করার শক্তি, রূপ-সৌন্দর্য, জ্ঞান-বুদ্ধি এবং দুনিয়াতে অর্জিত সকল ভালো মন্দ আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়ে থাকে। আমার বর্তমান মর্যাদা ও অবস্থান আমার এই একীনকে আরও সুদৃঢ় করেছে”।

এরপর যুবক রাজা সিংহাসনে আরোহণ করে বন্ধুদের ডেকে পাঠালো, ব্যবসায়ী পুত্রকে মন্ত্রী পরিষদে, এবং কৃষকপুত্রকে কৃষিবিভাগে নিযুক্ত করে দিল। আর নিষ্কর্মা আমীর পুত্রকে প্রচুর ধন-সম্পদ দিয়ে দেশান্তর করা হলো। যেন তার সৌন্দর্যের যাদুতে মোহগ্রস্ত হয়ে কেউ ধোঁকায় না পড়ে।

তারপর রাজা দেশের সমস্ত গুণীজনদের একত্রিত করে সংক্ষেপে একটি ভাষণ দিলেন। “আমি তাকদীরের বিশ্বাসী ছিলাম। কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে যা দান করেছেন সবই আমার তাকদীরে পূর্বেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন। জ্ঞান সৌন্দর্য বা পরিশ্রম দিয়ে আমি এসব অর্জন করিনি। যখন আমার ভাই আমাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করলো তখন আমি ছিলাম কপর্দকহীন। রাজ্যপতি হওয়া তো দূরের কথা, জীবন যাপনের কোন অবলম্বন আমার নিকট ছিলো না। এ শহরে আমার চেয়ে সুদর্শন, জ্ঞানী, কর্মঠ মানুষের অভাব নেই। তা সত্ত্বেও আল্লাহ পাকের ইচ্ছাই আমাকে সম্মান দ্বারা ভূষিত করেছে। এটা আমার কৃতিত্ব নয়।

উপদেশ : মানুষ নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রচেষ্টা-সাধনা দ্বারা তাকদীরে নির্ধারিত থাকা বস্তু ব্যতীত বেশি কিছু অর্জন করতে পারে না। কিন্তু তাকদীরে নির্ধারিত কোন বিপদ বা সৌভাগ্য ; সে হাজারো সাবধানতা বা উদাসীনতা সত্ত্বেও বিনা বাঁধায় পেয়ে যাবে।

6 thoughts on “শিক্ষণীয় ঘটনা : হারিয়ে যাওয়া চার যুবক ও তাকদীর

  1. হারিয়ে যাওয়া চার যুবক সম্বলিত কাহিনিটার দলিল দিলে উপকৃত হতাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *