টাই এর কথা কুরআনে আছে? লা-মাযহাবী কাজী ইব্রাহীম সাহেবের কুরআন অপব্যাখ্যার জবাব

 


মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী


বিশিষ্ট আহলে হাদীস সালাফী আলেম শাইখ কাজী ইবরাহীম বলেছেন–

“টাই মুসলিম গৌরবের স্মরণিকা। জাকির নায়েকের টাই বৈধ। টাই-এর কথা কুরআনে আছে। কুরআনে সূরাহ আম্বিয়ার ১০৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে–
كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ
এখানে উল্লেখকৃত طَيِّ হচ্ছে টাই। কুরআনের আয়াতের طَيِّ থেকেই টাই এসেছে। …”

আসতাগফিরুল্লাহ। কুরআনের আয়াত নিয়ে মস্কারী!! আহলে হাদীস শাইখদের মধ্যে এ কেমন ধৃষ্টতাপূর্ণ মূর্খতা! তা কুফরীর পর্যায়ে পড়ে।

জনকণ্ঠ পত্রিকা ব্যঙ্গ কার্টুন ছেপে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলো–وَهَٰذَا الْبَلَدِ الْأَمِينِ “এটা আমিনের বলদ”। তখন এ নিয়ে কুরআনপ্রেমিক মুসলমানদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে এবং অবশেষে জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। কাজী ইবরাহীম সাহেবের বর্ণিত উক্তি (কুরআনের আয়াতের طَيِّ হচ্ছে টাই) দ্বারা তো প্রথম আলোর সেই কুরআনের আয়াত নিয়ে ব্যঙ্গ করার মতোই হলো!! নাউযুবিল্লাহ।

কুরআনের উক্ত আয়াতে কিছুতেই টাইয়ের কথা বলা হয়নি এবং টাই (tie) আরবী শব্দও নয়। এটা ইংরেজী শব্দ এবং নেকটাই (Necktie) থেকে গ্রহিত রূপ। যার ব্যবহার মূলে ক্রোয়েশীয়দের মধ্যে প্রচলিত হয়ে পরবর্তীতে ফরাসী, বৃটেন ও আমেরিকায় স্থান করে নিয়েছে।

বস্তুত পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতে কিয়ামতের সময় পৃথিবীর অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন–
يَوْمَ نَطْوِي السَّمَاءَ كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ
“সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব–দস্তাবেজ-এর লিখিত কাগজসমূহকে গু্টানোর ন্যায়।” (সূরাহ আম্বিয়া, আয়াত নং ১০৪)

এ আয়াতে কিয়ামতের উক্ত অবস্থা সম্পর্কেই বলা হয়েছে। এ আয়াতের طَيِّ শব্দকে উল্লিখিত অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। সকল অভিধান, তাফসীর, হাদীস প্রভৃতি গ্রন্থে এর এ অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। কোথাও এর অর্থ টাই বলা হয়নি। প্রমাণের জন্য দেখুন : তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৫ম খণ্ড, ৩৮২ পৃষ্ঠা/ আল-জামি‘ লি-আহকামিল কুরআন, ১২শ খণ্ড, ২৫২ পৃষ্ঠা/ আজওয়াউল বায়ান ফী ঈজাহিল ‍কুরআন, ২৪৮ পৃষ্ঠা/ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম–কিতাবুত তাফসীর প্রভৃতি)

বলুন, এ আয়াতে টাইয়ের কথা কোথায় আছে? এখানে যে طَيِّ শব্দ রয়েছে, এর অর্থ তো টাই নয়। এটা হচ্ছে প্রথমে বর্ণিত نَطْوِي ক্রিয়ার মাসদার বা ক্রিয়ামূল–যার অর্থ গুটানো। অথচ টাই হচ্ছে বিশেষ্য–যার পরিচয় সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে– a long piece of cloth worn for decorative purposes around the neck (একটি দীর্ঘ কাপড়-টুকরা যা গলায় গ্রন্থিবদ্ধরূপে সম্মানচিহ্নসংক্রান্ত উদ্দেশ্যে ধারণ করা হয়)। এক্ষেত্রে টাই গলায় লটকিয়ে সম্পূর্ণটা প্রসারিত করে বুকের উপর ধারণ করা হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে–আরবী طَيِّ যে অর্থ (গুটানো) দেয়, টাই তার উল্টো অর্থে (প্রসারিত করে ঝুলানো) ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং طَيِّ -এর অর্থে টাইকে গণ্য করলে টাইকে প্রসারিত না করে গুটিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু তা তো করা হয় না।

বলা বাহুল্য, এ আয়াত দ্বারা কিছুতেই টাই-এর বৈধতা প্রমাণ করা যাবে না। কুরআন ও হাদীস-তাফসীরের কোথাও এ আয়াতে বর্ণিত طَيِّ -কে টাই বলা হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম (রা.) খেকে এ আয়াতের এ শব্দ দ্বারা টাই অর্থ কোথাও বর্ণিত হয়নি। পারলে হাদীস ও তাফসীরের রেফারেন্স দেখান–চ্যালেঞ্জ করছি।

সুতরাং এমতাবস্থায় টাইকে কুরআনের طَيِّ বলে উল্লেখ করা কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করা অথবা ব্যঙ্গ করার শামিল। যা সম্পূর্ণ কুফরী কাজ।

অপরদিকে টাই হচ্ছে বিধর্মীদের ঐতিহ্যগত ভূষণ। ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া তাদের এ ঐতিহ্যগত কালচারের মূলে রয়েছে থার্টি ইয়ার্স ওয়ার-এর সময় (1618-1648) যখন ক্রোয়েশীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত থেকে তাদের ঐতিহ্যগত গ্রন্থিবদ্ধ টাই গলায় ধারণ করে–সেই থেকে তার ব্যাপক প্রচলন হয়। তা ছাড়া রাজা চতুর্দশ লুই (1646) ফরাসি আভিজাত্যের ফ্যাশন হিসেবে গলায় নেকটাই ঝুলান। তার অনুকরণে তখন থেকে তার ব্যবহার ব্যাপকতা পায়। আর ক্রমে তা ইউরোপে একটি ফ্যাশন উন্মত্ততার রূপ ধারণ করে। বিস্তারিত দেখুন উইকিপিডিয়ার নিম্নোক্ত লিঙ্কে–
https://en.wikipedia.org/wiki/Necktie

বলা বাহুল্য, মুসলমানদের কালচারকে বিধর্মীদের কালচারের সাথে পর্যবসিত করতে হাদীস শরীফে নিষেধ করা হয়েছে। তাই মুসলমানদের জন্য বিজাতীয় কালচারের টাই ব্যবহার বিধেয় নয়।

আবার অনেক মুহাক্কিক টাইকে খৃস্টানদের ক্রুশের প্রতীক সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেন–যেমনভাবে খৃস্টানরা যীশুর শূলীবিদ্ধ হওয়ার কল্পিত বিশ্বাসকে ধারণ করে তার প্রতীকরূপে গলায় ত্রিমাথা বিশিষ্ট ক্রশপ্রতীক ধারণ করেন, তেমনি পোশাক-আভিজাত্যে তার প্রতীকী প্রতিফলনরূপে তাদের মধ্যে টাইয়ের উদ্ভব হয়েছে।

সে হিসেবে টাই বা নেকটাইকে খৃষ্টীয় ক্রুশ প্রতীকের স্তাবক-চিহ্ন ও খৃষ্টানদের ধর্মীয় কালচার বলা যায়। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক বহু দলীল-প্রমাণও তারা পেশ করেন। নিম্নে তার কিছু দলীল-প্রমাণ উদ্ধৃত করা হলো–

█ প্রখ্যাত মুসলিম লেখক কুরাইশী সাবেরী ক্রুশ প্রতীক সম্পর্কে ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট প্রকাশ করে বলেন, “উনিশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপীয়রা তাদের ডিকশনারী ও এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে প্রাথমিক যে সকল বিষয় (খৃষ্টীয় জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে এমন) বাদ দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘টাই ক্রুশের প্রতীক’-এর দলীল। ১৮৯৮ সালের পূর্বে প্রিন্টকৃত এনসাইক্লোপিডিয়ার একটি পৃষ্ঠায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়। উক্ত পৃষ্ঠার আলোকচিত্র নিম্নে লিঙ্কে দেখুন–
http://www.taajushshariah.com/Fatawa/tie.html

█ টাই-এর ইতিহাস ঘেটে জানা যায়–ক্রুশের চিহ্নরূপে টাই ধর্মীয় পরিচয় হিসেবে খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচলন লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ষোড়শ শতাব্দীর কিছু আগে ক্রুশের চিহ্ন টাইকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে চীন ও রোমান সেনাদের সামরিক ইউনিফর্মে অন্তর্ভূক্ত করে দেয়া হয়। তেমনিভাবে ১৬১৮ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্য বিজয়ের পর ক্রোয়েশিয়ান সামরিক ফ্রন্টিয়ার প্যারিস পরিদর্শনে রাজা লুই চতুর্দশের সামনে ক্রুশের স্মারক-চিহ্ন টাই পরে নিজেদেরকে উপস্থাপন করেন।

ইতিহাসের এ পরম্পরায় ১৭৯০ সালে পোপের পক্ষ থেকে সকল খৃষ্টানকে ক্রুশের প্রতীকরূপে টাই পরিধান করার জন্য বিশেষ তাকীদ দেয়া হয়। অতঃপর ১৮৫০ সালের মধ্যে সকল খৃষ্টানজাতি বিষয়টি গ্রহণ করে এবং এ ব্যাপারে পোপের আদেশ জারি করে দেয়।”

(বিস্তারিত দেখুন : http://www.taajushshariah.com/Fatawa/tie.html)

উল্লিখিত বর্ণনার দ্বারা স্পষ্টরূপে বুঝা যাচ্ছে–খৃষ্টানদের ধর্মীয় চিহ্ন রূপেই তাদের মধ্যে টাইয়ের প্রচলন হয়েছে। টাই পরা খৃষ্টানদের আবহমান কাল ধরে চলে আসা ধর্মীয় ঐতিহ্য। তা ছাড়া টাই যে ইউরোপে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বিজাতীয় ভূষণ-কালচার এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই মুসলমানদের জন্য টাই ব্যবহারকে কোনভাবেই জায়িয বলা যায় না।

অথচ কাজী ইবরাহীম সাহেব নিদ্বিধায় জাকির নায়েকের টাই পরাকে জায়িয বলে দিলেন। উপরন্তু তার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করে ফেললেন! নাউযুবিল্লাহ। তার এ কাজকে ধৃষ্টতা ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

আশা করি, কাজী সাহেব তার ভুল শুধরে নিয়ে তাওবা করবেন এবং বক্তব্যের সংশোধনের ঘোষণা দিবেন। অন্যথায় তাকে ফিতনা গণ্য করে তার থেকে দূরে থাকা মুসলমানদের কর্তব্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *