যে বিয়ে হয়েছিলো আকাশে


লিখেছেন – শিহাব আহমাদ তুহিন


এক | ইতিহাসে যে মানুষটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে তিনি হচ্ছেন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা.)। ভাবতে অবাক লাগে, সেই তিনিই ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি যিনি একটা জাতির ব্যবসা-বাণিজ্য, রীতি-নীতি থেকে শুরু করে সবকিছু প্রায় রাতারাতি সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধচারীরা যখন তাঁর দেখানো অনুপম আদর্শের চেয়ে ভালো কিছু প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে তাঁর পবিত্র ব্যক্তিগত জীবনের দিকে। যাদের নিজেদের ভালো-খারাপের কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই, তারাই বলতে গেলে তাঁর জীবনের প্রায় সবকিছুরই সমালোচনা করেছে। এই সমালোচনার লিস্টে তাদের খুব প্রিয় একটা টপিক “রাসূল (সা.) ও যয়নাব (রা.) এর বিয়ে।”

যয়নাব (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.) এর ফুফাতো বোন এবং তাঁর আযাদকৃত দাস এবং একসময়কার পালকপুত্র যায়েদ বিন হারেছার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী। যয়নাব (রা.) এর সাথে রাসূল (সা.) এর বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করে এবং তাতে নিজেদের কল্পনার রঙ ছড়িয়ে ইসলাম-বিদ্বেষীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, রাসূল (সা.) একজন নারীলোভী ছিলেন এবং তিনি যয়নাব (রা.)-কে অর্ধ-উলঙ্গ দেখে তাঁর রূপে আসক্ত হয়ে তাঁর প্রেমে পড়ে যান এবং পরবর্তীতে তাঁকে বিয়ে করেন। এক্ষেত্রে তারা ইবনে ইসহাক, আল ওয়াকিদী, ইবনে সাদ এবং ইবনে জারীর তাবারী থেকে উদ্ধৃত করে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত করা হয় ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) এর গ্রন্থ থেকে।

তাবারী (রহঃ) এর গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার পূর্বে আমি পাঠকদের এই তথ্যটুকু দিতে চাই যে, রাসূল (সা.) সম্পর্কিত কোনো বর্ণনা বা উদ্ধৃতি পেলেই মুসলিমরা সেটাকে সত্যরূপে গ্রহণ করে না। পূর্ববর্তী আলেমগণ বেশ নিষ্ঠার সাথে গড়ে তুলেছিলেন “হাদীস শাস্ত্র”। তাঁরা দেখিয়েছিলেন কীভাবে একটি হাদীস সঠিক, দুর্বল কিংবা মিথ্যা কিনা তা নির্ণয় করা যায়। একটি হাদীসের মূলত দুটি ভাগ থাকে। একটি হচ্ছে সনদ বা তথ্যসূত্র এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে মতন বা বর্ণনা। একটি হাদীস বেশ কয়েকজন রাবী (হাদীস বর্ণনাকারী) বর্ণনা করে থাকেন; যদি প্রত্যেক রাবী বিশ্বস্ত এবং ধারাবাহিক না হয়ে থাকেন, তবে সে হাদীস গ্রহণযোগ্য হয় না। ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) তাঁর গ্রন্থে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে এ নীতির প্রয়োগ করেননি। তিনি ভালো-খারাপ সকল ব্যক্তির কাছ থেকেই বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তাঁর তাবারী গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেন,

“আমি পাঠকদের সতর্ক করতে চাই যে, কিছু মানুষ আমার নিকট যে খবর বর্ণনা করেছে, এই বইয়ে আমি তার উপর নির্ভর করে সবকিছু লিখেছি। আমি কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই গল্পগুলোর উৎস হিসেবে বর্ণনাকারীদেরকে (ধরে) নিয়েছি … । যদি কেউ আমার বইয়ে বর্ণিত কোন ঘটনা পড়ে ভয় পেয়ে যান, তাহলে তার জানা উচিৎ যে, এই ঘটনা আমাদের কাছ থেকে আসেনি। আমরা শুধুমাত্র তাই-ই লিখেছি যা বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে পেয়েছি।”

ইবনে কাসির (রহঃ), ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) এর এই নীতির সমালোচনা করে লিখেন, “ইমাম ইবনে জারীর (রহঃ) এরূপ বহু অসার বর্ণনা করেছেন যা সঠিক নয়, যেগুলো বর্ণনা করা উচিৎ নয় বলে আমরা তা ছেড়ে দিলাম। কেননা, এগুলোর মধ্যে একটিও প্রমাণিত ও সঠিক নয়।”[১]

অপরদিকে ইবনু হাজার (রহঃ), ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ)-কে কিছুটা ডিফেন্ড করে লিখেন, “এটি তাবারীর একক বিষয় নয় এবং এই বিষয়ে তাঁকে পৃথকভাবে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ মনে করতেন যে, সনদসহ সহীহ হাদীস উল্লেখ করলেই দায়িত্ব পালিত হয়ে গেলো এবং তাঁরা যিম্মাদারী থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন।”[২]

দুই | এখন দেখা যাক, ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) আসলে কী লিখেছিলেন যা নিয়ে মুহাদ্দিসগণ এতটা আপত্তি তুলেছিলেন। ইবনে জারীর তাবারী (রহঃ) তাঁর তারীখ (৩/১৬১) এবং ইবনে সাদ তাঁর তাবাকাত (৮/১০১) গ্রন্থে উল্লেখ করেন,

“মুহাম্মাদ ইবনে উমার বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর আল আসলামী বলেছেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে হিশাম বলেছেন “রাসূল (সা.) যায়েদ বিন হারেছার বাসায় তাঁকে খুঁজতে গেলেন, তখন যায়েদ কে বলা হতো ‘মুহাম্মাদের পুত্র’। কিন্তু তিনি তাঁকে বাসায় খুঁজে পেলেন না। এমতাবস্থায়, যয়নাব তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে তাঁর রাতের পোশাক পরে বের হলেন। নবী (সা.) তাঁর মুখ ফেরালেন এবং তিনি (যয়নাব) বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! সে এখানে নেই, দয়া করে ভেতরে আসুন।’ কিন্তু নবী (সা.) (ভেতরে প্রবেশ করতে) রাজি হলেন না। তিনি (যয়নাব) রাতের পোশাক পরে বের হয়েছিলেন, কারণ তাঁকে বলা হয়েছিলো নবী (সা.) দরজায় দাঁড়িয়ে, তাই তিনি তাড়াহুড়ো করেছিলেন। তিনি নবীর হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন। নবী (সা.) অস্পষ্ট গুঞ্জন করতে করতে বের হয়ে গেলেন, (যার মধ্যে শুধু এতোটুকু বোঝা গেলো) ‘সকল প্রশংসা তাঁর যিনি হৃদয়ের পরিবর্তন করেন।’ যখন যায়েদ বাসায় আসলেন তখন তাঁকে বলা হলো, নবী (সা.) তাঁদের বাসায় এসেছিলেন। যায়েদ তখন যয়নাবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি তাঁকে ভেতরে আসতে বলোনি?’ যয়নাব বললেন, ‘আমি বলেছিলাম কিন্তু তিনি আসেননি।’ যায়েদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনি কি কিছু বলে যাননি?’ যয়নাব (রা.) বললেন, ‘তিনি গুঞ্জন করতে করতে বের হয়ে গেলেন, আমি তার কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু এতটুকু বলতে শুনেছিলাম, ‘সকল প্রশংসা তাঁর যিনি হৃদয়ের পরিবর্তন করেন।’

তারপর যায়েদ, রাসূল (সা.) এর কাছে আসলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমাকে বলা হয়েছে আপনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন কিন্তু ভেতরে আসেননি। যদি এটা এই কারণে হয়ে থাকে, আপনি যয়নাবকে পছন্দ করেন, তাহলে তাকে আপনার জন্য আমি ত্যাগ করব। কিন্তু নবী (সা.) বললেন, ‘তোমার স্ত্রীর সাথে থাকো’। এরপর যায়েদ পুনরায় জিজ্ঞেস করলে নবী (সা.) আবার বললেন, ‘তোমার স্ত্রীর সাথে থাকো।’ কিন্তু যায়েদ যয়নাবকে তালাক দিলেন এবং তাঁর ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেলো। এরপর (একদিন) নবী (সা.) যখন আয়েশা (রা.) এর সাথে কথা বলছিলেন তখন জিবরাইল (আঃ) তাঁর কাছে ওয়াহী নিয়ে আসলেন। তিনি স্বস্তি পেলেন এবং হেসে হেসে বললেন, ‘কে যয়নাবের কাছে যাবে এবং তাকে বলবে যে আল্লাহ তাকে আমার স্ত্রী বানিয়েছেন।’ তারপর তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন, ‘আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন … ’ থেকে শেষ পর্যন্ত।”

এবার আমরা দেখি এ বর্ণনার সনদে কোনো সমস্যা আছে কিনা!

প্রথম সমস্যা
মুহাম্মাদ ইবনে উমার আল ওয়াকেদীকে মিথ্যাবাদী বলা হয়। আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, ‘সে একজন মিথ্যাবাদী, যে কিনা হাদীস বানাতো।’ মুরা বলেছেন, ‘তার হাদীস লিখা উচিৎ না।’ দারকান্দী বলেছেন, ‘তার মধ্যে দুর্বলতা আছে।’[৩]

দ্বিতীয় সমস্যা
আবদুল্লাহ ইবনে আমীর আল আসলামীকে দুর্বল বলা হয়।ইবনে হাজার আল আসকালানী এবং আমীর আল মাদানি তাকে দুর্বল বলেছেন।[৪]

তৃতীয় সমস্যা
মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহিয়া। তিনি বিশ্বস্ত কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনি কখনো নবী (সা.) এর সাথে সরাসরি কথা বলেননি। ইমাম আয-যাহবী বলেছেন, ‘তিনি ৪৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।’[৫] আমরা জানি নবী (সা.) ১১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তাই নবী (সা.) ও ইবনে ইয়াহিয়ার জন্মের মাঝে প্রায় ছত্রিশ বছরের ব্যবধান ছিলো।

তিন | ইবনে তাবারী (রহঃ) তাঁর বই আল তারিখে (২২/১৩) একই ঘটনা একটু অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন:

“ইউনুস আমাকে বলেছেন, নবী (সা.) যায়েদ বিন হারিছাকে তাঁর ফুফাতো বোন যয়নব বিনতে জাহশের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন নবী (সা.) তাঁকে খুঁজতে তাঁর বাসায় গেলেন, তাঁর বাসায় দরজা বলতে ছিলো কেবল একটুকরো কাপড়, বাতাসে কাপড়টি উড়ে গেলো এবং যয়নাবকে প্রকাশ করে দিলো।উনার পা অনাবৃত ছিলো। তিনি নবীর হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন এবং তারপর থেকে তিনি অপরজনকে (যায়েদকে) ঘৃণা করতেন। একদিন যায়েদ নবী (সা.) এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমি আমার স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চাই।’ তিনি [নবী(সা.)] বললেন, ‘কেন? তোমার কি তার ব্যাপারে কোন সন্দেহ আছে?’ তিনি (যায়েদ) উত্তর দিলেন, “না! আল্লাহর শপথ! আমার তার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।আমি তো তার মাঝে কেবল ভালোই দেখেছি।’’ তারপর নবী (সা.) বললেন, ‘তোমার স্ত্রীর সাথে থাকো এবং তার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো! এই কারণেই আল্লাহ বলেছেন, ‘তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত।’[৬]

এই হাদীসটি মুদিল (অর্থাৎ, কমপক্ষে দুইজন বর্ণনাকারী এখানে মিসিং), কারণ ইবনে যায়েদ সাহাবী কিংবা তাবেয়ী কোনোটাই ছিলেন না। এছাড়া এখানকার বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য নন।

চার | এবার ইবনে ইসহাকের বর্ণনা উল্লেখ করছি:

“যায়েদ অসুস্থ থাকার কারণে রাসূল (সা.) তাঁকে দেখতে যান।যায়েদের স্ত্রী যয়নাব তখন তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁর সেবা করছিলেন। যখন তিনি (যয়নাব) কিছু কাজ করতে বাইরে গেলেন, তখন নবী (সা.) তাঁর দিকে তাকালেন, তাঁর মাথা নিচু করলেন এবং বললেন, ‘সকল প্রশংসা তাঁর! যিনি চোখ ও হৃদয়ের দিক পরিবর্তন করেন।’ তখন যায়েদ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে আপনার জন্য তালাক দিবো?’ কিন্তু নবী (সা.) জবাব দিলেন, ‘না।’ তারপর এই আয়াত অবতীর্ণ হলো, ‘আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত।”[৭]

এই হাদীসটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর কোনো সনদই উল্লেখ করা হয়নি, এছাড়া ইবনে ইসহাক রচিত ‘সিরাত ইবনে হিশাম’ গ্রন্থে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

পাঁচ | সুতরাং, আমরা বুঝতে পারলাম যে তিনটি হাদীসেরই সনদে বড়সড় সমস্যা আছে। এবার যদি আমরা হাদীসগুলোর মতন বা বর্ণনাগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে অনেক অসামঞ্জস্য দেখতে পাবো। কোথাও বলা আছে যয়নাব (রা.) রাতের পোশাক পরে বের হন, আরেক জায়গায় বলা আছে বাতাসে পর্দা উড়ে যাওয়াতে যয়নাব (রা.) এর পা দেখা গিয়েছিলো। ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় যায়েদ (রা.) অসুস্থ ছিলেন অপরদিকে তাবারীর বর্ণনায় যায়েদ(রা.) বাসার বাইরে ছিলেন। কীভাবে একজন মানুষ একইসাথে অসুস্থ হয়ে বিছানায় আবার বাসার বাইরে একইসময়ে থাকেন?

অনেকে ভাবতে পারেন এই গল্পগুলো কিতাবগুলোতে আসলো কীভাবে যদি সত্যিই এর কোনো উৎস না থেকে থাকে। এর কারণ সম্ভবত দুইটি:

১) আল ওয়াকেদী যিনি কিনা মিথ্যাবাদী হিসেবে সুপরিচিত, তিনি এই গল্পটি তৈরি করেছিলেন।

২) বাইবেলে বর্ণিত রাজা দাউদ ও বাতসেবার গল্প পড়ে কেউ এই গল্পটি তৈরি করেছে।[৮] গল্পটিতে রাজা দাউদ, সুন্দর দেহের অধিকারী বাতসেবাকে নগ্ন অবস্থায় গোসল করতে দেখে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে বাতসেবার স্বামীকে হত্যা করে বাতসেবাকে নিজের কাছে নিয়ে নেন।

মুহাম্মাদ (সা.) কেন যয়নাব (রা.)-কে বিয়ে করেছিলেন?
এর কারণটা জানতে হলে আমাদের ইতিহাসটা একটু নিরপেক্ষভাবে জানার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমে দেখি যায়েদ (রা.) ও যয়নাব (রা.) এর বিয়ে পূর্ব ও পরবর্তী প্রেক্ষাপট কেমন ছিলো। জনপ্রিয় ও অন্যতম বিশুদ্ধ তাফসির গ্রন্থ তাফসির ইবনে কাসির আমাদের বলছে,

“রাসূল (সা.) যায়েদ বিন হারেছার পয়গাম নিয়ে যয়নাব বিনতে জাহশ (রা.) এর কাছে হাজির হন। তিনি (যয়নব) উত্তর দিলেন, “আমি তাকে বিয়ে করবো না।”[৯]

যয়নাব (রা.) এর সরাসরি প্রত্যাখ্যান অনেকের কাছে বেশ রুঢ় মনে হতে পারে, কারণ এখানে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং রাসূল (সা.)। কেন তিনি সরাসরি না করেছিলেন? এর উত্তর দিয়েছেন মাওলানা ইদরীস কান্ধলবী (রহঃ) তাঁর ‘সীরাতে মোস্তফা’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন,

“যায়েদ বিন হারেছা (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.) এর আযাদকৃত ক্রীতদাস। অপরদিকে হযরত যয়নাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত খানদান পরিবারের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মহিলা। সেই সাথে তিনি ছিলেন রাসূল (সা.) এর ফুফাতো বোন। আর দেশের সামাজিক প্রচলন হিসেবে তাঁরা আযাদকৃত ক্রীতদাসের সাথে আত্মীয়তা গড়াকে খুবই আপত্তিকর, মানহানিকর ও অশোভনীয় বলে বিবেচনা করতেন। আর তাই রাসূল (সা.) যখন তাঁর আযাদকৃত গোলাম যায়েদের জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিলেন তখন যয়নাব ও তাঁর ভাই তা সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন।[১০]

এ পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশ এলো:
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” [সূরা আহযাব (৩৩):৩৬]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির বর্ণনা করেন, “এটা (আয়াতটা) শুনে যায়নাব (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.), আপনি কি এ বিয়েতে সম্মত আছেন?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন হযরত যয়নাব (রা.) বললেন, ‘তাহলে আমারও কোনো আপত্তি নেই। আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) এর বিরোধিতা করবো না, আমি তাকে আমার স্বামী হিসেবে বরণ করে নিলাম।’[৯]

যারা আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতায় বিরক্ত হচ্ছেন, তাদেরকে বলব ধৈর্য ধরে আরেকটু পড়ে যেতে। কারণ এতক্ষণ যা আলোচনা করেছি তা অনেক সন্দেহ নিরসন করবে। সূরা আল আহযাবের ৩৮ নং আয়াত এখানে ভেঙ্গে ভেঙ্গে উল্লেখ করছি:

i) আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন: এ আয়াতে যায়েদ বিন হারেছার (রা.) কথা বলা হয়েছে।তাঁর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছিলো। তাঁকে আল্লাহ ইসলাম ও নবী (সা.)-কে খুব কাছ থেকে অনুসরণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অপরদিকে, যায়েদ (রা.) যখন খাদিজা (রা.) এর ক্রীতদাস ছিলেন, তখন তাঁর চাল-চলন রাসূল (সা.)-কে মুগ্ধ করে এবং তিনি তাঁকে মুক্ত করে দেন। তিনি ছিলেন রাসূল (সা.) এর পালকপুত্র আর সবাই তাকে ‘যায়েদ বিন মুহাম্মাদ’ ডাকতো। এটা ছিলো যায়েদ (রা.) এর প্রতি রাসূল (সা.) এর বিশেষ অনুগ্রহ।

কিন্তু আল্লাহ তা’আলা পালক পুত্রের বিধান রহিত করে দিলেন এবং পিতৃ-পরিচয় জানার পরেও কাউকে ভিন্ন নামে ডাকতে নিষেধ করে দিলেন:

“আল্লাহ কোনো মানুষের মধ্যে দুটি হৃদয় স্থাপন করেননি। তোমাদের স্ত্রীগণ যাদের সাথে তোমরা যিহার করো, তাদেরকে তোমাদের জননী করেননি এবং তোমাদের পোষ্যপুত্রদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ ন্যায় কথা বলেন এবং পথ প্রদর্শন করেন।” [সূরা আহযাব (৩৩):৪]

আল্লাহ খুব সুন্দরভাবে আমাদের উপমা দিয়ে বোঝাচ্ছেন; যেভাবে মানুষের মধ্যে দুইটা মন থাকতে পারে না, ঠিক একইভাবে কেউ পুত্র না হয়েই পুত্রের পরিচয় বহন করতে পারে না, এটা আমাদের মুখের কথা মাত্র এবং আমাদের মনের সাথে তার কোনো সংযোগ নেই। তেমনিভাবে, যদি নিজেদের স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করি (যিহার-জাহিলি যুগের এক ধরনের তালাকের নিয়ম), তবে তারা আমাদের মা হয়ে যায় না, স্ত্রীই থাকে।পরবর্তীতে রাসূল (সা.) আর যায়েদ (রা.)-কে নিজের পুত্র হিসেবে সম্বোধন করেননি, বরং বলেছিলেন, “তুমি আমার ভাই এবং বন্ধু।”[১১]

ii) তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো: এ আয়াতটি আলোচনায় চলুন আবার ‘সীরাতে মোস্তফা’ গ্রন্থটিতে ফিরে যাওয়া যাক: “আল্লাহর হুকুম মোতাবেক যায়েদ বিন হারিছা (রা.) এর সাথে যয়নব (রা.)- এর বিবাহ হয়ে গেলো। বিবাহ তো হয়ে গেলো, কিন্তু যয়নাবের দৃষ্টিতে যায়েদ নীচ ও হীনই রইলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে বনিবনা হলো না মোটেই। যায়েদ (রা.) বারবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট যায়নাব (রা.)-এর বেপরোয়া ভাবভঙ্গী এবং যায়েদকে উপেক্ষা করার অভিযোগ করতে লাগলেন। এ অবস্থায় তিনি বারবার যয়নাবকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।” রাসূল(সা.) বিয়ে ভাঙ্গতে নিষেধ করেন এবং বলেন, ‘তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো।’ [১২]

iii) আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত: পূর্বে ইমাম তাবারী (রহ.) থেকে যে বর্ণনা উল্লেখ করেছি, তাঁর সাহায্যে অনেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন’ বলতে নবী (সা.) এর যয়নাব (রা.) এর প্রতি হঠাৎ আসক্ত হয়ে পড়াকে বোঝানো হয়েছে। প্রাচ্যের অনেক লেখকই এ বর্ণনার সাথে নিজেদের কল্পনার রং ছড়িয়ে যাচ্ছেতাই লিখেছে তাদের বইয়ে।[১৩]

হঠাৎ আসক্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি আসলে কিছু মানবমনের কল্পনা ছাড়া কিছুই না। কারণ,

প্রথমত, ইমাম তাবারী যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তা নির্ভরযোগ্য নয়।

দ্বিতীয়ত, যদিও ধরে নেই সে হাদীস নির্ভরযোগ্য, তবুও রাসূল (সা.) এর হঠাৎ যয়নাবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়াটা অবাস্তব। কারণ, যয়নাব (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.) এর ফুফাতো বোন। রাসূল (সা.) তাঁর রূপ, গুণ সম্পর্কে বহু পূর্বে অবগত ছিলেন।

তৃতীয়ত, যদি এটাও ধরে নেই তিনি আসলেই যয়নাবের প্রতি আসক্ত ছিলেন, তাহলে কেন তিনি যয়নাবকে যায়েদের সাথে বিয়ে দিবেন? সেরকমটা হলে তো তিনি নিজের জন্যই প্রস্তাব দিতেন।

তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, ‘অন্তরে যে বিষয় গোপন করেছিলেন’ বলতে তাহলে কী বুঝানো হয়েছে? মুসনাদে আবু হাতিমে রয়েছে যে, যয়নাব বিনতে জাহশ (রা.) যে রাসূল (সা.) এর স্ত্রী হবেন, এ কথা বহু পূর্বে আল্লাহ তাঁকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) এ কথা প্রকাশ করেননি বরং তিনি যায়েদ (রা.) কে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে বলেছিলেন। তাই আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করে বোঝালেন এ কথা রাসূল (সা.) যতই গোপন রাখুন না কেন, আল্লাহতায়ালা তা প্রকাশ করে দিবেন।

iv) অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোনো অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে: এ আয়াতে আল্লাহতা’আলা একেবারে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, কেন আল্লাহতা’আলা যয়নাব (রা.)-কে রাসূল(সা.) এর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে পোষ্যপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার মাধ্যমে ‘পালকপ্রথা’ চিরতরে দূর হয়ে যায়। পরবর্তীতে যায়েদ (রা.) যখন যয়নাব(রা.) এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তাঁর ইদ্দত পূর্ণ হয়ে যায়, তখন রাসূল (সা.) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণ করেন।

যয়নাব (রা.) রাসূল (সা.)-কে বলতেন, ‘আল্লাহতা’আলা আমার মধ্যে এমন তিনটি বিশেষত্ব রেখেছেন যা আপনার অন্যান্য স্ত্রীদের মাঝে নেই। প্রথম এই যে, আমার নানা ও আপনার দাদা একই ব্যক্তি। দ্বিতীয় এই যে, আপনার সাথে আমার বিয়ে আল্লাহতা’আলা আকাশে পড়িয়েছেন।আর তৃতীয় এই যে, আমাদের মাঝে সংবাদ-বাহক ছিলেন জিবরাইল(আঃ)।’

যয়নাব (রা.) রাসূল (সা.) এর অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে বেশ গর্ব করে বলতেন, ‘তোমাদের বিয়ে দিয়েছেন তোমাদের অভিভাবক ও ওয়ারিশগণ।আর আমার বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা সপ্তম আকাশের উপর।’ (বুখারি)

যারা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ইনসেস্ট,সমকামিতার মত জঘন্য বিষয়গুলোকে বৈধতার রায় দেন, তারা এরপরেও ঠিক কীসের ভিত্তিতে এই বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেন তা আমার বোধগম্য নয়। আর আমার এই লিখাটা তাদের জন্যও নয় যাদের একমাত্র রেফারেন্স হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষ। এ লেখাটা তাদের জন্য যারা হৃদয় দিয়ে সত্য খুঁজে।

আমি বিশ্বাস করি হৃদয়টাকে খোলা রেখে সত্য খুঁজলে পরম করুণাময় তার করুণার ধারা অবশ্যই বর্ষণ করবেন।


গ্রন্থসূত্র ও তথ্যাবলী


[১] তাফসির ইবনে কাসির (১৫ নং খন্ড, পৃষ্ঠা-৮০৫)

[২] লিসানুল মিযান ৩/৭৪

[৩] মিযান আল-আতিদাল ফি নিকাদ আল রিজাল, ইমাম শামস আল দীন আল যাহবী (খন্ড ৬, পৃষ্ঠা-২৭৩)

[৪] তাকবীর আল তাদীব, ইবনে হাজার আসকালানী (পৃষ্ঠা ২৫১)

[৫] সিয়ার আল আম আল নুবালা, ইমাম শামস আল দ্বীন আল যাহবী (খন্ড ২, পৃষ্ঠা-৫৬২)

[৬] The history of Al Tabari-The victim of Islam, Translated by Michael Fishbein [State University of New York Press, Albany, 1997] (Volume VIII, pp. 2-3)

[৭] জেনারেল আহমাদ আবুল ওয়াহাব, তাঅ’আদুদ নিসা আলা আমিয়া ওয়া মাকান্নাত আল মার’আ ফি আল ইয়াহুদিয়া ওয়া আল মাসিয়াহ ওয়া আল ইসলাম (পৃষ্ঠা-৬৮)

[৮] Holy Bible, 2 Samuel, Chapter 11

[৯] তাফসির ইবনে কাসির (১৫ নং খন্ড, পৃষ্ঠা-৮০৫)

[১০] সীরাতে মোস্তফা, মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.) (পৃষ্ঠা- ৭২৮)

[১১]তাফসির ইবনে কাসির (১৫ নং খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৩৮)

[১২] সীরাতে মোস্তফা, মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.) (পৃষ্ঠা- ৭২৮)

[১৩] The life of Mohamed, William Muir (Vol. 3, page-231)


সৌজন্যে: মুসলিম মিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *