সন্তানদের প্রতি যে ১৪টি ভুল বাবা মা করে থাকেন

মুফতি সাঈদ আল হাসান
————————–

আমরা শিশু হয়ে একদিন এ পৃথিবীতে এসেছিলাম।  আবার চলে যাব কোন একদিন। আর প্রাকৃতিক নিয়মেই কেউ কেউ রেখে যাব সন্তান সন্ততি।

সন্তানের পিতা মাতা হওয়াটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।  শুধু জন্মদান ও খোরপোশ দিলেই এই দায়িত্ব পালন হয়ে যায় না। সন্তানকে সঠিক উপায়ে “মানুষ” বানানোও বাবা মা’র একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।  সন্তানকে কিভাবে ‘মানুষ’ বানাতে হবে ও লালন পালন করতে হবে, এ বিষয়ে আরেকদিন লিখব।  আজ আমরা মাসিক আদর্শ নারীর পাঠকদের উদ্দেশে আলোকপাত করতে যাচ্ছি- সন্তান লালন পালনে যে সকল ভুল ভ্রান্তি বাবা মা করে থাকেন সে বিষয়ে।  চলুন শুরু করি-

 

১) বাচ্চাদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ না করা :

বাচ্চাদের সবসময় কড়াকড়ির মধ্যে রাখলে বাচ্চা অভিভাবকদের ভয় পেতে শুরু করবে।  যার ফলে লুকিয়ে লুকিয়ে এমন অনেক কিছু করতে শুরু করতে পারে, যা বিপদ ডেকে আনবে।  তা ছাড়া এ ধরনের আচরণ অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করে থাকে।  ধীরে ধীরে তারা পরস্পর দূরে সরে যেতে থাকবে।  তাই উত্তম হল, সন্তানের বন্ধু হয়ে তার পাশে থাকা।  এতে সন্তানরাও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে বাবা মা’কে পাশে পেয়ে ।

২)পড়াশোনায় ফেল মানে লাইফে ফেল :

মোটেও না ! অনেক বিখ্যাত আলেমে দ্বীন পরীক্ষায় ফেল করেও জগত উজ্জ্বল করেছেন।  আপনার ছেলে-মেয়ে পারে নি পাশ করতে।  ঠিক আছে, পরের বার ভালো করবে।  একটা চান্স দিয়ে দেখুন না ! ওর প্রতিভাকে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করুন।  সবাইকে তো টপার হতে হবে না। সে নিশ্চয়ই সামাজিক কাজে, লেখালেখিতে, ক্যালিগ্রাফিতে বা রান্না বান্নায়, কিছু একটাতে ভালো।  সেটা তার আসল ক্যারিয়ার হতে পারে।  গজল শিল্পী, ইমাম, মুয়াজ্জিন, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ওয়েব ডেভেলপার ইত্যাদি হওয়াও তো মন্দ নয়।  মাছ পানিতে চলে আর কাঠবিড়ালি গাছে…. মাছকে গাছে বসিয়ে দিলে নিশ্চয়ই সে বাঁচবে না, তেমনই কাঠবিড়ালিও পানিতে মরে যাবে।  অতএব অযথা পড়াশোনার চাপ দেয়া ভুল।  আমাদের দেশের বাচ্চাদের সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়ছে, সেটা খেয়াল রাখা উচিত !

৩) নিজের অসম্পূর্ণ ইচ্ছে বাচ্চাদের ঘাড়ে চাপানো :

আগের পয়েন্টটার মতন খানিকটা।  আমি যেমন, আমার সন্তানও হবে তেমন। আমার মতো বুদ্ধিমান হবে। সবকিছুতে সে সেরা হবে। সন্তান যখন গর্ভে থাকে, তখন থেকেই মা-বাবারা এমন চিন্তা করেন। কিন্তু বাস্তবে সন্তান আপনার মতো নাও হতে পারে। তাই আগেভাগে কোনো কিছু কল্পনা না করাই ভালো।  বাবা ডাক্তার হতে পারেনি তাই ছেলেকে ডাক্তার হতে হবে! কেন ?? ছেলের ইচ্ছে বলতে কিছু নেই ? নিজে জীবনে ব্যর্থ হওয়ার ঝালটা কেন সন্তানের উপর ঝাড়তে হবে ? কে কী হতে চায় জীবনে এটা সম্পূর্ণ তাকে ডিসাইড করতে দেওয়া উচিত।   হ্যাঁ গুরুজনের পরামর্শের দাম তো আছেই, তবে তাদের কথাই শেষ কথা কখনোই হওয়া উচিত না। তবে প্রয়োজন পরিমাণ দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষা দেয়াটা আবশ্যক।

৪) কোন বিষয়ে নিজে ভালো করে না জেনে বাচ্চাকে জ্ঞান দেওয়া :

বাচ্চাদের কাছে অভিভাবক হচ্ছে তাদের গুরু।  তারা তাদের গুরুজনদের অনুসরণ করে। তাই কিছু বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার আগে, শেখানোর আগে নিজেই ভালো করে শিখে নেওয়া উচিত। “আমিই” ঠিক/ আমি সব জানি attitude থাকলে বাচ্চারাও তাই করবে। ভুল জানবে/শিখবে এবং অন্যদের সামনে বোকা বা অহংকারী হওয়ার পরিচয় পাবে। তাই এ বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।

৫) মাতৃভাষা ভালোভাবে না শেখানো :

নিজের মাতৃভাষা না জানার মধ্যে কোন স্মার্টনেস নেই, সেটা ছোটদের ভালো ভাবে বোঝানো উচিত।  নিজের মাতৃভাষাটা সবার আগে লিখিয়ে পড়িয়ে আত্মস্থ করে দিতে হবে, এরপর অন্যান্য ভাষার প্রতি মনোযোগ দিতে পারে।

৬) যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে সতর্ক না করা :

চরম দুঃখজনক হলেও সত্যি যে,  এই যুগে ছয় মাসের শিশুও মানুষরূপী পশুর বলী হচ্ছে।  তাই যৌন নির্যাতন নিয়ে ছোট থেকেই সতর্ক করা অত্যন্ত জরুরী।  good touch/bad touch (ভালো স্পর্শ- মন্দ স্পর্শ) কাকে বলে, আর কেউ যদি bad touch দেয়ার মতন কোন স্পর্ধা দেখায়, তাহলে কী করা উচিত ; এটা অভিভাবকেরাই বেশি ভালো করে বোঝাতে পারবে।  কারণ সন্তানরা তাদেরই সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করে পৃথিবীতে।  সতর্ক করলেই আগে থেকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো যায় ।

৭) আত্মরক্ষার জন্য ট্রেন না করা :

আজকালকার দিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বাচ্চাদের ক্যারাটে বা কুংফু জাতীয় কোন মার্শাল আর্টস শেখানো কেবল মাত্র আত্মরক্ষার জন্য।  বিশেষ করে কন্যাসন্তানদের।  বাবা-মা’রা সব জায়গায় সন্তানদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।  কাজেই বিপদে আপদে নিজেদেরকে নিজেদেরই রক্ষা করা ক্ষমতা থাকা উচিত। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি বেশি প্রয়োজন আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো।

৮) তুলনা করা :

প্রত্যেক শিশুই আলাদা হয়, তাদের আলাদা গুণ/দোষ থাকে, তাই অন্যের সন্তান কতটা ভালো আর নিজেরটা কত বড় আহাম্মক তা রেগে গেলেও বলা উচিত না, সন্তানের মনকে এরকম ভাবে আঘাত করাটা একেবারেই অনুচিত।  এতে তাদের আত্মবিশ্বাস/মনোবল ভেঙ্গে যাবে।

৯) নিজের সন্তানকে অন্ধের মত সাপোর্ট করা :

সন্তান সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা শুনতে চান না মা-বাবা। তারা মনে করেন, তাদের সন্তান কোনো ভুল করতে পারে না। এতে সন্তানও হয়তো ভাবতে পারে, তারা যে কাজ করেছে, সেটি মা-বাবার কাছে কোনো ভুল নয়।  এভাবে অন্ধের মতন সাপোর্ট করা ঠিক না।  সে ভুল করলে তার ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলা, দরকার হলে বকুনিও দেয়া উচিত।  প্রয়োজনে হালকা শাসন।  নইলে সে ঠিক ভুল বিবেচনা করতেই শিখবে না।

১০) সময় না দিয়ে, দামী উপহার দেওয়া বা যা চাইছে তা-ই হাতের মুঠোয় এনে দেওয়া :

অনেক সময় দেখা যায় অভিভাবকরা সন্তানদের সময় দিতে পারেন না তাই সেই guilty feeling এড়াতে সন্তানের সব বায়না মেটাতে চান আর এর ফলে সন্তানরাও বিগড়ে যায়।  অর্থের মূল্য বুঝতে দেওয়া উচিত।  সময়ের দাম এবং জিনিসের মূল্য এক হতে পারে না কখনো।  তাই নিজের যতটুকু সময় হয় সেটা বাচ্চাটিকে দিন, কোন materialistic gift এর বিকল্প হতে পারে না।

১১) দত্তক নেওয়া সন্তানদের পরিচয় গোপন করা :

অসহায় বাচ্চাকে দত্তক নেওয়া সওয়াবের কাজ।  নিজের কোলও ভরে যায় এবং একটি শিশু পৃথিবীর সুখ আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত হওয়া থেকেও রক্ষা পায়।  তবে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে সেই বাচ্চার আসল সত্যটি তাকে জানানো উচিত বলে মনে করি।  বড় হলে সে নিজে যখন তার বন্ধুদের মত তার মা-বাবার চেহারার সাথে মিল খুঁজবে আয়নায়, তখন যদি অন্য কারোর থেকে তার গোপন সত্যটি জানে, তখন সে আরও দুঃখ পাবে।  ঘৃণা/রাগও হতে পারে এবং আরও দূরে সরে যেতে পারে তার এতোদিনের চেনা মা-বাবার থেকে।  তাই নিজেরাই যদি যত্নের সাথে তাকে বুকে টেনে নিয়ে সত্য বলে দেয়া যায়, তাহলে সেটাই শ্রেয়।  এর ফলে বড় হয়ে সে মানুষটি আরও বেশি শ্রদ্ধা করবে তার ফস্টার প্যারেন্টসদের অর্থাৎ পালক বাবা মা’দের, যখন তার সবটাই বোঝার মত বয়স হবে।

১২) অতিরিক্ত আদর করা
মা-বাবা সন্তানকে ভালোবাসবেন, এটাই স্বাভাবিক।  কিন্তু অতিরিক্ত ভালোবাসা সন্তানের ক্ষতির কারণও হতে পারে।  সন্তানের সব কথা মানা অথবা সব জিদ পূরণ করলে ভবিষ্যতে তাকে আয়ত্তে আনা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।  তাই সন্তানের কিছু ইচ্ছা বা শখ এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

১৩) শৈশব হারিয়ে ফেলা
শিশুর কাছ থেকে তাদের শৈশব কেড়ে নেওয়া ঠিক নয়। বাবা বা মায়েরা মাঝেমধ্যে সন্তানকে এমন পড়ালেখার চাপের মধ্যে রাখেন যে বাচ্চারা অনেক সময় খেলাধুলা বা বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগই পায় না।  এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শৈশব।  শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সিলেবাসের বাইরের বইপত্রও সন্তানকে পড়তে দেওয়া উচিত। তাতে বাচ্চাদের শৈশব অনেক বর্ণিল হয়ে ওঠে।

১৪) অবজ্ঞার চোখে দেখা
একটি পরীক্ষার ফল বা পুরস্কারের ট্রফির চেয়ে আপনার সন্তান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে যদি কোনো কিছুতে জিততে না পারে, তাহলে তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখবেন না। তাকে জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে বাধ্য করবেন না। তাকে অন্য কাজে উৎসাহ দিন। আজ হয়তো আপনার সন্তান সামান্য প্রতিযোগিতায় সাফল্য পায়নি, তাতে কী! ভবিষ্যতে দেখবেন, আপনাকেই তারা বড় জয় এনে দেবে। সুতরাং উৎসাহ দিন, আস্থা হারাবেন না।

আপাতত এই ক’টা কথাই মাথায় এলো।  আশা করি, অভিভাবক হতে হতে ততোদিনে আরো অনেক কিছু শিখে নেবো …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.