মেয়েদের মাসিক চলাকালীন পরিচ্ছন্নতা : গুরুত্ব ও করণীয়

ডা. তাসনিম তামান্না
—————-

নারীমাত্রই শিশু জন্মদানের বয়সসীমা মানে ১২ থেকে ৫১ বছর বয়সের মাঝে প্রতিমাসে যে ঝক্কি পোহান, তার নাম হচ্ছে মেনস্ট্রুয়াল পিরিয়ড তথা হায়েজ বা সহজ বাংলায় আমরা যেটিকে মাসিক বলি। ঝক্কি বলছি এজন্য যে, এসময়টা একজন নারীকে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে পার হতে হয়। হরমোনের তারতম্যই মূলত এ সমস্যাগুলোর প্রধান কারণ। তবে এই মেনস্ট্রুয়াল পিরিয়ড বা হায়েজকালীন সময় এক অর্থে নারীদের শিশু জন্মদানের ক্ষমতারও প্রতীক। কাজেই কষ্ট হলেও একে সকল নারী হাসিমুখেই মেনে নেন।

তবে এই মাসিকের সাথেই যে বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হলো- মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন তথা মাসিক চলাকালীন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, যা বেশিরভাগ নারীরাই গুরুত্বের সাথে নেন না। দুঃখজনক হলেও সত্যি- এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও অনেক নারীই স্যানিটারি প্যাড এর বদলে কাপড় ব্যবহার করেন। ওয়েস্ট বেঙ্গলে এক স্টাডিতে দেখা যায়, মাত্র ৪৯ শতাংশ নারী স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তবে এর মাঝে মাত্র ১২ শতাংশ নারী প্যাড ব্যবহার করেন। বাংলাদেশেও এই হার খুব একটা বেশি হবার কথা নয়।

তবে প্যাড ব্যবহার করছেন কিনা তার সাথে সমান গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হচ্ছে, প্যাড সময়মতো পাল্টাচ্ছেন কিনা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সঠিক নিয়মে স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার এবং মেনস্ট্রুয়াল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আমাদের মাঝে প্রচণ্ড ধোঁয়াশা কাজ করে। কারণটা আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতা।

পিরিয়ডের মতো প্রাকৃতিক একটি বিষয়কে আমরা এখনো একটি “সোশ্যাল ট্যাবু” এর মতো ট্রিট করি। এখনো পিরিয়ড হলে ঘর থেকে বেরোতে আমরা দু’বার ভাবি, যেন কী একটা খারাপ জিনিস এটা! যতদিন না সমাজের সংকীর্ণতা কমবে, ততদিন হয়তো মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে ভুল বা কম ধারণাটা কারেকশনের সুযোগটাও ঠিক তৈরি হবে না।

যাই হোক, যে কারণে এই পোস্টটির সূচনা, তা হলো স্যানিটারি প্যাড সময়মতো না পাল্টালে ক্ষতিটা আসলে কী?

– ক্ষতি আসলে অনেক, অনেক সময় তা অপূরণীয়। প্রথমত মাসিকের সময় আমাদের দেহ থেকে দূষিত রক্ত বেরিয়ে যায়। আর রক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাসের ব্রিডিং গ্রাউন্ড। সেইসাথে দীর্ঘক্ষণ একই প্যাড পরে থাকার কারণে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে এসব মাইক্রোবের জন্মগ্রহণে সুবিধা হয়। ফলাফল- ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, স্কিন র‌্যাশ, ভ্যাজাইনাল থ্রাশ বা ফাংগাল ইনফেকশন।

দ্বিতীয়ত, সময়মতো প্যাড না পাল্টালে তা রিপ্রোডাক্টিভ ট্র্যাক্ট এর দীর্ঘমেয়াদী ইনফেকশন তৈরি করতে পারে, যার পরিণতি গড়াতে পারে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত!

এখন প্রশ্ন হলো স্যানিটারি প্যাড কীভাবে ব্যবহার করবেন?

– আপনাকে অবশ্যই প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা অন্তর প্যাড পাল্টাতে হবে, তা আপনার হেভি ফ্লো হোক বা লাইট ব্লিডিং এই রুল সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

– অনেকেই এক্সট্রা প্রটেকশনের জন্য দুই রকমের স্যানিটেশন সিস্টেম যেমন ট্যাম্পন এবং প্যাড একসাথে ব্যবহার করেন। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। কেননা প্যাড চার ঘণ্টা পর বদলালেও ট্যাম্পন সাধারণত প্রতি দু’ঘণ্টায় একবার পাল্টাতে হয়। যেহেতু দু’ধরনের মেথড ব্যবহৃত হচ্ছে তাই হয়তো তা মনে নাও থাকতে পারে এবং উপরোল্লিখিত সমস্যাগুলো হতে পারে।

এছাড়াও যে বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখা উচিৎ:

– মেন্সট্রুয়েশনের সময় রোগ বালাই থেকে বাঁচানোর কাজটি করে আমাদের দেহে উপস্থিত “গুড ব্যাকটেরিয়া” যা ঘন ঘন সাবান ব্যবহারের ফলে ক্ষারীয় পরিবেশে মরে যায়। কাজেই এসময় সাবান-পানি এর বদলে শুধু নাতিশীতোষ্ণ পানি ব্যবহারই ভালো। তবে অবশ্যই প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর বা প্যাড বদলের আগে গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করতেই হবে।

– টয়লেট ব্যবহারের পর অবশ্যই পেশাবের পথ থেকে পায়ুপথের দিকে পরিষ্কার করবেন। কখনোই (পিরিয়ড না থাকাকালীন সময়েও) উল্টোভাবে পরিষ্কার করবেন না, কেননা তাতে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন এর ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।

ইদানীংকালে ইউ.টি.আই এবং ভ্যাজাইনাল থ্রাশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পাচ্ছি বলে এ বিষয়ে লেখা একপ্রকার ফরজ হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। এর মাঝে অনেকেই আবার এর তার কথায় মেডিসিন খেয়ে বা মেখে ক্রনিক এবং কমপ্লিকেটেড কেইস বানিয়ে আমাদের কাছে আসেন। এ ভুলটি ভুলেও করতে যাবেন না।

এ ধরনের সমস্যায় পড়ামাত্রই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন, নাহলে হয়তো আপনাদেরও কারও বন্ধ্যাত্বের মত অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *