ইয়াহইয়া বিন আবু বকর নদভী
ফ্রান্সে বর্তমান ক্ষমতাসীন ম্যাক্রোঁ সরকারের একটি নির্দেশের অধীনে নানান আইনি অজুহাত দেখিয়ে মুসলমানদের ৪০০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি৷ একই সঙ্গে সেখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন বিল পাস হতে যাচ্ছে।
সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে ফ্রান্সের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারী নির্দেশনায় মুসলমানদের অন্তত ৪০০ টিরও বেশি দোকান ও স্থাপনা বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির “মিডিয়া পার্ট” নিউজ সাইট।
আজ(বৃহস্পতিবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১) ফরাসি “মিডিয়া পার্ট” ওয়েবসাইট জানায়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারি আদেশে এবং মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় ১৮ হাজার পরিদর্শনকর্মি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয়৷ এবং তাদেরকে যে কোনোভাবে আইনি অজুহাত খুঁজে, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ অভিযোগ আরোপ করে দেশের মুসলমানদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার নির্দেশ দেয়৷
নিউজ সাইটটি প্যারিসের দক্ষিণে, ‘মৌলিন’ শহরে একটি রেস্তোঁরা বন্ধ করার আইনসঙ্গত কারণ না থাকা সত্ত্বেওও আইনের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে বন্ধ করার নির্দেশনা সম্বলিত মন্ত্রণালয়ের একটি ইমেল প্রকাশ করেছে।
“মিডিয়া পার্ট” -এর বর্ণনা অনুযায়ী কমিটির অন্যতম পরিদর্শক (যার নাম উল্লেখ করা হয়নি) বলেছিলেন, ‘দোকানের মালিকদের চরমপন্থার সাথে কোনও যোগসূত্র না থাকলেও যে কোনও মূল্যে কিছু দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো৷’
মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, মন্ত্রকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো অজুহাত খুঁজে মুসলিম দোকান বন্ধ করা জাতীয় সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন৷
মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত বিল পাস
এদিকে ফরাসি জাতীয় সংসদের একটি বিশেষ কমিটি “প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নীতিমালা” নামে একটি বিল পাশের অনুমোদন করতে যাচ্ছে, যা প্রথমে
গত ২ অক্টোবর, ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রন “বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই” নামে প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক আপত্তি আসার পর নামটি পাল্টে “প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মূলনীতি” শিরোনামে পরিবর্তন করা হয়।
এই বিলটি যে মুসলমানদের জন্য চরম হুমকি, এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কেননা এটি মূলত ফ্রান্সের মুসলমানদের দমন-পীড়নের জন্যই তৈরি করা হয়েছে৷ বিলটিতে এমন কিছু নীতিমালা রয়েছে, যা মুসলিম জীবনের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই বিধিনিষেধ আরোপ করে। এবং বিভিন্ন পন্থায় ইসলামকে কলংকিত ও বিকৃত করে এমন কিছু বিষয় দেখাতে চায় যার সাথে ইসলামের সামান্যতম সম্পর্ক নেই৷
কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হলো:
এক. ” ইসলামোফোবিয়া” এর মাধ্যমে ফ্রান্স সরকার অন্যা ধর্মালবলম্বীদের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে ঘৃণা ও ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়৷ যাতে নতুন করে কেউ ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী না হয়৷ তারা প্রচার করতে চায় যে, ইসলাম হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী ধর্ম৷ আর এটা প্রমাণ করার জন্য তারা “আই এস”এর উদাহরণ নিয়ে আসে। তারপর এদের কর্মকান্ডের ভিডিও ফুটেজগুলো ফলাও করে প্রচার করে বলে, ইসলাম চরমপন্থা ও সন্ত্রাস শিক্ষা দেয়৷ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করতে শেখায়৷
এভাবে তারা শুধু ইসলামই নয়, ইসলামের পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিধান জিহাদকেও কলুষিতভাবে উপস্থাপন করে৷ এভাবে সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থী দমনের অজুহাতে নানাভাবে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালায় এবং তাদের ধর্মীয় বিষয়াদিতে নানাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷
দুই. বিলটির আরেকটি নীতি হলো- মুসলমানদের মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কড়া নজরদারি করা। পাশাপাশি এগুলো পরিচালনাকারী সমিতি এবং মুসলিম নাগরিক সংস্থার অর্থায়ন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা।
তিন. যেসব প্রদেশ ও অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পূর্বে হিজাব পরা নিষিদ্ধ ছিলো সেখানে মুসলিম নাগরিকদের তাদের বাচ্চাদের জন্য ঘরে কিংবা আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
চার. এই বিলে রোগীদের তাদের লিঙ্গ এবং ধর্মভেদে বা অন্যান্য কারণে ভিন্ন ডাক্তার নির্বাচন করা নিষেধ। অর্থাৎ মুসলিম হলে মুসলিম ডাক্তার, নারী হলে নারী ডাক্তার নির্বাচন নিষেধ৷ এবং সরকারি খাতের সকল কর্মচারীদের জন্য “ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা” বাধ্যতামূলক। চাই সে যে ধর্মেরই হোক৷
এই বিলটি এই ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
লক্ষণীয় যে, অধিক সংখ্যক মুসলমানের দিক থেকে ফ্রান্স অন্যতম বৃহত্তম ইউরোপীয় দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে ইউরোপের দেশগুলোতে বিশেষকরে ফ্রান্সে মুসলমানদের জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে দেশটি ২০-৩০ বছরের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হতে পারে৷ হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি অনুযায়ী তার দেশে জন্মলাভ করা ৫০ শতাংশ শিশুই মুসলিম৷ মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াই মূলত ইসলামবিদ্বেষী ফ্রান্স সরকারের এত শত্রুতা, প্রপাগান্ডা এবং হিংসা৷
তথ্যসূত্র: আখবারুল খলীজ, এ্যারাবিক আরটি ডট কম