সংসারে হাঁসি ফোটাবার আশায় সৌদি গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে এলো কিশোরী

কিশোরী উম্মে কুলসুমের বয়স ১৪ বছর। সংসারের হাল ধরতে তাকেই ২৬ বছর দেখিয়ে পাসপোর্ট করানো হয়। এরপর ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরবে পাড়ি জমায় এই কিশোরী। কিন্তু মালিকের পৈশাচিক আচরণ, নির্যাতন ও মারধরের শিকার হয়ে সে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। দেশ থেকে জীবিত যাওয়া কুলসুম ফিরল লাশ হয়ে।

গত শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে কফিনে বন্দী লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গুনিয়াউক ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের পৌঁছায়। এ সময় বৃদ্ধ মা–বাবা, বোন, স্বজন ও প্রতিবেশীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অসহায় এ দরিদ্র এই পরিবারে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

কিশোরী কুলসুম নূরপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও নাসিমা বেগমের মেয়ে। তার বাবা সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ের নায়েব ছিলেন। ২০ বছর হলো তিনি আর কাজে নেই। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে কুলসুমের অবস্থান দ্বিতীয়। অভাবগ্রস্ত কুলসুমের পরিবারের এখন পাঁচজন সদস্য রয়েছে। প্রবাসে পাড়ি জমানোর সময় কুলসুম নূরপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সনদ ও পাসপোর্টের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সালে উপজেলার নূরপুর লাহাজুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় কুলসুম। সনদ অনুযায়ী ২০০৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে কুলসুম। সে হিসেবে তার বর্তমান বয়স ১৩ বছর ৮ মাস ১৯ দিন। কিন্তু পাসপোর্টে তার জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৩ মার্চ ১৯৯৩। পাসপোর্টের জন্মতারিখ অনুসারে তার বর্তমান বয়স ২৭ বছর ৫ মাস ৩০ দিন। গোকর্ণ ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান হাসান ও বর্তমান ইউপি সচিব আজাদুর রহমান স্বাক্ষরিত জন্মসনদ সূত্রেই তার পাসপোর্ট করা হয়। ২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তারা কুলসুমের জন্মসনদ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জারি করেন।

ইউপি সচিব আবিদুর রহমান বলেন, কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জন্মনিবন্ধন দেওয়া হয়। আর ওই জন্মনিবন্ধনে যে স্বাক্ষরটি রয়েছে, তা দেখে মনে হচ্ছে স্বাক্ষরটি আমার। কিন্তু যাচাই না করে জন্মনিবন্ধন দেওয়ার কথা না। কেউ কম্পিউটার স্ক্রিনের মাধ্যমেও আমার স্বাক্ষর বসিয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি খোঁজ নেব।
কুলসুমের পরিবার স্থানীয় দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ২৪ জুন নাসিরনগর থানা এবং শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া মেয়ের লাশ দেশে আনতে এবং কর্মী নিয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে গত ১৭ আগস্ট জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) মহাপরিচালকের কাছে লিখিত আবেদন করেন।

নিহতের পরিবার, স্থানীয়, থানায় দেওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গৃহকর্মীর কাজে সৌদি আরবে পাঠানোর প্রস্তাব দেন আ. রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি। আ. রাজ্জাকের কথায় গত বছরের ৭ এপ্রিল ঢাকার ফকিরাপুলের মেসার্স এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ দিয়ে কিশোরী কুলসুমকে সৌদি আরবের রিয়াদে পাঠান। বেতন কম দেওয়াসহ রিয়াদের মালিকপক্ষ কিশোরী কুলসুমকে শারীরিক নির্যাতন করে। বিষয়টি নিয়ে দালাল আ. রাজ্জাকের সঙ্গে কুলসুমের পরিবার মনোমালিন্য চলে। ওই কিশোরীকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে পরিবারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকাও নেন দালাল। একপর্যায়ে বেতন পাঠানো বন্ধসহ দুই মাস ধরে কুলসুমের কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না বলে দালালকে অবহিত করে পরিবারের লোকজন। ৬ জুন আ. রাজ্জাকের সঙ্গে কুলসুমের পরিবারের ঝগড়া হয়। সে সময় বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কুলসুমের কোনো খোঁজ দেবে বলে হুমকি দেন আ. রাজ্জাক। পরে কুলসুমের বাবা শহিদুল ইসলাম বিএমইটির কাছেও লিখিত অভিযোগ করেন।

কুলসুমের মা নাসিমা বেগম বলেন, প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পাবে বলে জানিয়েছিলেন আ. রাজ্জাক। কিন্তু মেয়ে ১৫ হাজার টাকা বেতন পেত। প্রথম সাত মাস টাকা পাঠিয়েছে। একপর্যায়ে মেয়ে ছয় মাস নিখোঁজ ছিল। তিনি বলেন, গত রমজান মাসের শেষ রোজার দিন দুপুরে ফোন করে মেয়ে হাসপাতালে আছে বলে আমাদের জানায়। মেয়ে জানায় মালিক হাত, পা ও কোমর ভেঙে ও চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। তিনি বলেন, কোরবানি ঈদের পরদিন মেয়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়। তখন পরিবারের কাউকে চিনতে পারেনি কুলসুম। গত ১০ আগস্ট মেয়ের মৃত্যুর খবর পান।

কুলসুমের বড় বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে হাবিবা বলেন, বাবার পেনশনের টাকা ও কুলসুমের পাঠানো টাকায় কোনোমতে সংসার চলত।

এ ব্যাপারে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এটিএম আরিচুল হক জানান, দুই দেশের বিষয় হওয়ায় নাসিরনগর থানা পুলিশের পক্ষে কোনেও ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কোনেও ধরনের নির্দেশনা পাইনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *