দ্বীনের কামিয়াবি একমাত্র আলেমদের অনুসরণকৃত পথেই রয়েছে : মাওলানা আহমদ লাট

মুসলিমদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ শুক্রবার বাদ মাগরিব বয়ান। ২০২০ সালের আলমী শূরার ইজতেমায় বাদ মাগবির আগত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে রূহানী বয়ান করেন ভারতের তাবলীগ জামাতের শূরা সদস্য মাওলানা আহমদ লাট। মাসিক আদর্শ নারীর পাঠকদের জন্য হুবহু বয়ানটি তুলে ধরেছেন নুরুদ্দীন তাসলিম।
—————————–

হামদ নাতের পর…

সম্মানিত উপস্থিতি আপনাদের সাধুবাদ। আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম হল কেউ কিছু তৈরি করলে প্রথমে তার উদ্দেশ্য ও ব্যবহারের নিয়ম বলে দেওয়।তেমনি পৃথিবীর সব মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য বলে দিয়েছেন। যেন মানুষ আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারে এবং রাসূল সা:-এর অনুসরণ করতে পারে। রাসূল সা:- এর অনুসরণের মাঝেই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করে অনুগ্রহ করেছেন এবং তিনি আমাদের সৃষ্টি করে ছেড়ে দেননি। সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা হুকুম দিয়েছেন।আমাদের জন্য হালাল হারাম বাতলে দিয়েছেন। আমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত বিধানগুলো জানা যাবে একমাত্র ওলামায়ে কেরামের সোহবতের মাধ্যমে।

দীন এ উম্মতের মুক্তি লাভের একমাত্র পথ।দীন ছাড়া অন্য কোনও পথে কামিয়াবি থাকলে আল্লাহ তায়ালা নবীদের তা দিয়ে পাঠাতেন। মুহাম্মদ সা: ও সব নবীদের আল্লাহ তায়ালা দীন ও দীনের মেহনত দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাই আমাদের সফলতার চাবিকাঠি দীন ও এ দীনের মেহনত।

দুই.

মানুষ ও অন্য জীবজন্তুর মাঝে পার্থক্য হল শরীয়ত।পশুপাখির জন্য ধরা বাঁধা কোন বিধান নেই। জান্নাত জাহান্নামের শাস্তির বিধান নেই। কিন্তু মানব জাতি এর বিপরীত। যে শিশুটি আজ জন্মগ্রহণ করেছে, এখনো বাবা-মাকে দেখেনি, তার জন্য আল্লাহ তায়ালার হুকুম। তার কানে আজান দাও, আল্লাহু আকবার বলো। অর্থাৎ আজানের মাধ্যমে তাকে বলা হচ্ছে, হে আল্লাহর বান্দা! যেন স্মরণ রেখো আল্লাহ সবচে’ বড়। এই বিশ্বাস তোমাকে স্থাপন করতে হবে।

পৃথিবীতে জীবন-যাপন করতে গিয়ে তুমি পাহাড় পর্বত, গাছপালা, আকাশ, জমিন বড় বড় যা কিছু দেখবে আল্লাহ তায়ালা তার থেকেও অনেক বড়। এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মিলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলে তিনি যত বড় হওয়া দরকার তিনি তার থেকেও বড়। তাই চাকরি -বাকরি কাজ কর্ম করতে গিয়ে তুমি ভুলে যেও না আল্লাহ তায়ালার বড়ত্বের কথা। জন্ম থেকেই এ কথার সবক নাও হে আল্লাহর বান্দা!

আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তরকে তার জন্য নির্ধারণ করেছেন।হুজুর সা: বলেছেন মানুষের শরীরে একটি অঙ্গ আছে তা বিশুদ্ধ হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাব, তাহলো অন্তর। আর আল্লাহ তায়ালা মানুষকে একটি অন্তর দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তাতে শুধু আল্লাহ তায়ালা বসবাস হবে।

মানুষের অন্তরে কোনকিছু প্রবেশের মাধ্যম চারটি। জবান, কান, দেমাগ, চোখ। মানুষ যা শুনে তা বলে। যখন ঘুমায় তখন চোখ, কান জবান বন্ধ হয়ে যায়। দেমাগ খোলা থাকে। তাই দেমাগে আল্লাহ তায়ালাকে ধারণ করতে হবে। আল্লাহ সবার বড় মানতে হবে। পৃথিবীতে সবকিছু মাটির তৈরি। সবকিছুর মাঝে মাটি কল্পনা করতে হবে। তাহলে আল্লাহকে বড় মনে হবে।তাই আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে বলেছেন, হে চাদরাবৃত! উঠুন মানুষকে আল্লাহর বড়ত্ব সম্পর্কে বলুন। আমাদের অন্তরে এটা বসাতে পারলে আমাদের এখানে আসা সফল হবে।

তিন.

আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের আহকামাত দিয়েছেন। বিয়ে-শাদী, চাষবাস, চাকরি কীভাবে করতে হবে, বলে দিয়েছেন। এসব থেকে পুরুষ-নারী, আবাল বৃদ্ধবণিতা শিশু কিশোর কাউকে নিষেধ করেননি। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন করতে বলেছেন।

সুদর্শন সাহাবী দাহইয়া কালবি রা:-এর সুরতে জিবরীল আঃ হুজুর সা: কাছে ওহী নিয়ে আসতেন।একদিন মসজিদে বসে রাসূল সা: জিবরীল আঃ-এর আসল আকৃতি দেখতে চাইলে জিবরীল আঃ ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যেতে বলেন।

একদিন আরাফার ময়দানে হুজুর সা: এলে জিবরীল আমিন বললেন, আজ আপনাকে আমার আকৃতি দেখাব। তখন জিবরীল আ: নিজের আকৃতি প্রকাশ করলে হুজুর সা: দেখেন আসমান জমিন যতদূর দেখা যায় পুরোটা জিবরীল আ:-এর আকৃতিতে ভরে গেছে।এরপর জিবরীল আ: বলেন আমার সাথী ইসরাফিল আমার থেকে আরো বার শ’ গুণ বড়।আল্লাহ তায়ালা তার এসব সৃষ্টির থেকেও বড়।

ইলিয়াস রহ. কে দাওয়াতের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন হুজুর সা: উম্মতকে যেই দীনের উপর রেখে গেছেন উম্মতকে তার উপর আবার ফিরিয়ে আনা। উম্মতের অন্তর থেকে গাইরুল্লাহর প্রভাব বের করা। যেন মানুষের অন্তরে শুধু আল্লাহ তায়ালা বসবাস করেন। পৃথিবীর চাকচিক্যের বিপরীতে আল্লাহর ভালবাসায় মানুষের হৃদয় ভরে যায়।

মানুষের অন্তরে রাসূলের সুন্নতের ভালবাসা জাগ্রত থাকে। যে ব্যক্তি রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করবে উম্মতের আবালবৃদ্ধ বনিতা সবার মাঝে আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালবাসা ও তার রাসূলের অনুসরণের যোগ্যতা দিয়েছেন তারা চাইলেই দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আল্লাহর মহব্বত নিয়ে অগণিত নেয়ামত সমৃদ্ধ জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব।

চার.

পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া প্রতিটি মানুষ তার পরবর্তীদের জন্য কিছু রেখে যায়। খয়রুল কুরুন ও তাবেয়ীদের বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে উম্মত শরিয়তে মুহাম্মদী থেকে সরে এসেছে।কাজে-কর্মে পোশাকআশাকে বিজাতিদের অনুসরণে লিপ্ত হয়েছে। উম্মতের এ দুর্যোগ মুহূর্তে ইলিয়াস রহ.-এর রূহানী জামাতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা উম্মতকে আবার ফিরিয়ে আনেন। তিনি মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে দীনের পথে ফিরিয়ে আনেন।

আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতের সবার উপর দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যান্য জামানার নবীদের যেভাবে দাওয়াতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।এই উম্মতকে সেভাবে দাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।তাই দাওয়াতের জিম্মাদারি পালন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব অন্তরে বসাতে হবে।এটাই ছিল সব নবীদের দাওয়াতের প্রথম ধাপ এবং ঈমান।

এই ঈমানের পরে দ্বিতীয় ধাপ হল নামাজ। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আমাদের জীবনে খুশির দিন ছিল দুটি; একটি হুজুর সা: যেদিন মেরাজ থেকে নামাজ নিয়ে আসেন, সেদিন আমাদের মনে হয়েছিল কাফেররা আমাদের খাবারের প্লেট কেড়ে নিয়ে গেলেও কোন সমস্যা নেই। নামাজকে তারা আল্লাহ থেকে চাওয়ার মাধ্যম হিসেবে নেওয়ার কারণে তারা এতো খুশি ছিলেন। এখনো সেই নামাজ আছে। তাই নামাজকে চাওয়ার মাধ্যম বানাতে হবে। আজ থেকে আমরা নামাজ না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করি।

অপরাধী চোরের হাত থেকে ঝরা রক্ত দেখে রাসূল সা: অঝোরে কেঁদেছেন । অথচ, লাকড়ি একত্রিত করে নামাজ তরককারিদের ঘর জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছেন। নামাজ উম্মতের অনেক বড় আমল জিম্মাদারি। তাই নিজে নামাজ পড়ব এবং অন্যদের দাওয়াত দেব।

সাহাবাদের খুশির দ্বিতীয় দিন হল একদিন এক সাহাবী রাসূল সা: কে বললেন, আমি আপনাকে ভালবাসি। রাসূল সা: তাকে বলেন, তাহলে তুমি কষ্ট সহ্য করতে তৈরি হয়ে যাও।কারণ, আমাকে ভালবাসার পথটা বন্ধুর।

(তিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের সাধুবাদ জানিয়ে বলেন আপনারা পুরো পৃথিবীর বিপরীতে গিয়ে সহজ সরলভাবে আল্লাহর বিধান মানেন।তরজমাকারী বলেন, আল্লাহ তায়ালা যেন এই বড় বুজুর্গের কথা সত্য করে আমাদের বিশ্ববাসীর হেদায়াতের আদর্শ বানান।)

এক সাহাবী রাসূল সা: কে বলেন, হে রাসূল আমি বড় আবেদ হতে চাই।রাসূল সা: বললেন, হারাম থেকে বেঁচে থাকো।

সাহাবী এসে নবিজী সা: কে ভালবাসার কথা বললে তিনি তাকে তার মায়ের মাথা কেটে আনতে বললেন। সাহাবি বিনা বাক্যব্যয়ে মায়ের মাথা কেটে আনতে বের হলে নবিজী সা: তাকে ডেকে বলেন, তোমার মায়ের মাথা কেটে আনার জন্য আমি নবী হইনি। আমার প্রতি তোমার আনুগত্য পরীক্ষার জন্য এ কথা বলেছি।আমাদেরও নবীজির আনুগত্য করতে হবে সাহাবিদের মত।

হুজুর সা: দাওয়াতের কাজে শত কষ্ট সয়েছেন। শিয়াবে আবু তালিবে নীরবে কষ্ট সয়েছেন দীনের জন্য।এই কষ্ট শেষে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে রাসূল সা: উম্মতকে এতিম করে ছেড়ে দেননি। কুরআন সুন্নাহ রেখে গেছে তাদের জন্য। কুরআন মানতে হলে আলেমদের অনুসরণ করতে হবে এবং এর দাওয়াত উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রত্যেক নারী-পুরুষের উপর এটা ফরজ। আমরা যদি দাওয়াত নিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ি, তাহলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহাবাদের জামাতের অন্তর্ভুক্ত করবেন।

পাঁচ.

শেষকথা হুজুর সা. বলেছেন, চাক্কির মত ঘুরো। উপর ও নিচ চাক্কির দুইটি অংশ থাকে। তেমনি দাওয়াতের কাজের নিচের অংশ হল- দৈনন্দিন ও সাপ্তাহিক কাজ আর উপরের অংশ প্রত্যেক বছরে বিদেশ সফরে বের হওয়া। বিদেশে বের হয়ে আমরা কীভাবে কাজ করব এসব আমাদের বড়রা তাদের কিতাব হায়াতে সাহাবা ও মালফুযাতে ইলিয়াসে লিখেছেন। তার অনুসরণ করা।

হযরত এনামুল হাসান রহ. বলেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং কাজে অনড় থাকো নিন্দুকের নিন্দা শুনিও না।যখন আমরা আল্লাহকে ভয় করে কাজের উপর অটল থেকে দাওয়াতের কাজ করব। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর দৃশ্যপট পালটে দিবেন।

আপনারা অনেক সৌভাগ্যবান! আপনাদের দেশে কাজের পরিবেশ আছে। আপনাদের দেশের বিপুল সংখ্যক আলেম ওলামার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে কাজ করুন।

ইলিয়াস রহ. দাওয়াতি কাজকে রেওয়াজি বানাতে নিষেধ করে বলেছেন, এমন করলে কাজের রূহ থাকবেনা। আলেমদের অনুসরণ করে কাজ করব।সর্বশেষ আল্লাহ তায়ালার বড়ত্বের কথা ভুলব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.