আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভে কিছু আমল

মুফতি এনায়েতুল্লাহ । । 

আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জন ও সন্তুষ্টি লাভ প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের পরম কাঙ্খিত বিষয়। তাই মুমিনমাত্রই চেষ্টা করেন আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করতে। নিয়মিত-ইবাদত-বন্দেগির পর এমন কিছু আমল রয়েছে যেগুলো পালন করলে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জিত হয়। এমন কিছু আমল হলো-

সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করা

সুখে-দুঃখে, বিপদ-মুসিবতে সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপরে ভরসা করে জীবন পরিচালনা করা মুমিন জীবনের অন্যতম দায়িত্ব। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর কেবল আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’ -সূরা ইবরাহিম: ১১

হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার জন্যই আত্মসমর্পণ করেছি, আপনারই প্রতি ঈমান এনেছি, আপনারই ওপর নির্ভর করেছি, আপনারই দিকে মনোনিবেশ করেছি এবং আপনারই জন্য কলহ করেছি।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম

মুসলমানদের মাঝে আপস-মীমাংসা করে দেওয়া

এই পৃথিবীর সবচেয়ে সহানুভূতিশীল মানবতার জন্য কল্যাণকামী জীবনব্যবস্থা হচ্ছে- ইসলাম। ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে। তাই মুসলমানদের মধ্যে বিবদমান সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের ওপরেই অর্পণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ -সূরা আল হুজুরাত: ১০

এ বিষয়ে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামিতা। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহ, তার কিতাব, তার রাসূল, মুসলিমদের ইমাম (নেতা) এবং সকল মুসলিমের জন্য।’ –সহিহ মুসলিম

পাড়া-প্রতিবেশীর অধিকার আদায় করা

আল্লাহতায়ালা তার ইবাদত করার সঙ্গে সঙ্গে পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীর অধিকার আদায় করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। যার মাধ্যমে একজনের সঙ্গে অন্য জনের সম্পর্ক অটুট হয়, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম-মিসকিন, নিকটাত্মীয়-প্রতিবেশী, অনাত্মীয়-প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে।’ -সূরা আন নিসা: ৩৬

এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আগমন করে আমাকে পড়শির বিষয়ে অবিরত উপদেশ দিতে লাগলেন। এমনকি আমার মনে হলো- হয়ত তিনি অচিরেই পড়শিকে ওয়ারিশ করে দেবেন।’ -সহিহ বোখারি

মেহমানকে সম্মান করা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা

ঈমানের সহায়ক ও ঈমান বৃদ্ধিকারী আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে মেহমানকে সম্মান করা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন অবশ্যই মেহমানকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখবে।’ –সহিহ বোখারি

নিজের হাতে হালাল জীবিকা উপার্জন করা

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ -সূরা জুমা: ১০

বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা এখানে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উদ্দেশ্য করেননি বরং সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, নামাজ সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা জমিনে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করো। নিজের হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ। হালাল রিজিক উপার্জন করা, হালাল রিজিক ভক্ষণ করা একজন মুমিনের ঈমানকে বৃদ্ধি করে। আর হারাম ভক্ষণ করলে বান্দার কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। তাই মুমিনের দায়িত্ব হালাল উপার্জন করা এবং হারাম উপার্জন পরিহার করা।

এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তার অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকো। জীবিকার সন্ধানে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করো না। কোনো ব্যক্তি তার জন্য নির্ধারিত রিজিক না পাওয়া পর্যন্ত মরবে না। যদিও তা পেতে কিছু বিলম্ব হয়। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং উপার্জনের উত্তম পন্থা অবলম্বন করো। হালাল পন্থায় উপার্জন করো এবং হারামের কাছেও যেয়ো না।’ -সুনানে ইবনে মাজা

ঋণগ্রস্তকে সহযোগিতা করা

সমাজের সচ্ছল মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে- সমাজের ঋণগ্রস্তদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। এটা ঈমানের জন্য সহায়ক একটি কাজ। এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করলে যার আনন্দ লাগে, সে যেন দরিদ্র ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় অথবা তার ওপর থেকে ঋণের বোঝা একেবারেই নামিয়ে দেয়।’ –সহিহ মুসলিম

সন্দেহজনক কাজ বর্জন করা

সর্বোত্তম ঈমানের মানদণ্ড হচ্ছে সন্দেহজনক হালাল থেকেও নিজেকে বিরত রাখা। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট। এ দুয়ের মাঝখানে সন্দেহজনক কিছু জিনিস রয়েছে। যে ব্যক্তি সন্দেহজনক গুনাহ বর্জন করবে, সে সুস্পষ্ট গুনাহ থেকে সহজেই রক্ষা পাবে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক গুনাহর কাজ করার দুঃসাহস দেখাবে, তার সুস্পষ্ট গুনাহর কাজে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গুনাহর কাজগুলো হচ্ছে- আল্লাহর নিষিদ্ধ এলাকা। যে জন্তু নিষিদ্ধ এলাকার আশপাশ দিয়ে বিচরণ করে, সে যে কোনো সময় নিষিদ্ধ এলাকার ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে।’ –সহিহ বোখারি

সৎ পরামর্শ প্রদান করা

একজন মুমিন সব সময় মানুষকে ভালো পরামর্শ দেবে, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করবে। এ সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি কাউকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করলে উদ্বুদ্ধকারী ব্যক্তি কাজটি সম্পন্নকারী ব্যক্তির তুল্য সওয়াব লাভ করবে। আর আল্লাহ বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা বড়ই পছন্দ করেন।’ -মুসনাদে আবি হানিফা

শেষ কথা

উপরোল্লেখিত আমলগুলো একজন মুমিনের ঈমান বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া আরও কিছু আমল রয়েছে যা বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ভালো আমল না মন্দ আমল তা অনুধাবন করা যায়। এ সব আমলকে অন্তরের কষ্টিপাথরে বিচার করে যেটা ভালো সেটা গ্রহণ করা বা মেনে চলা এবং যেটা খারাপ সেটা পরিত্যাগ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *