ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান ।।
দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে একটি করে জামাত বের করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিবছর টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ‘কালেমা, নামাজ, রোজা, ইল্ম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমীন, সহী নিয়ত ও দাওয়াতে তাবলীগ’- এ ছয়টি উসূল বা মূলনীতিকে সামনে রেখে তাবলীগ জামাত বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ধর্মের দাওয়াত নিয়ে গ্রাম-গঞ্জ, শহরে-বন্দরে সারা বছর ঘুরে ঘুরে বেড়ান। এ কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন নানা বয়সের বিভিন শ্রেণী-পেশার হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ।
ইসলাম প্রচারের কাজে তারা একদিকে নিজেকে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করার জন্য, অন্যদিকে যারা বেখেয়াল তাদের ধর্মের প্রতি আহ্বান করতে মেহনত করেন। বাংলাদেশের যে কোনো মসজিদ থেকে যে কেউ তাবলীগ জামাতের কাজে শামিল হতে পারেন। তিনদিন, সাতদিন, চল্লিশ দিন কিংবা সারা জীবনের জন্য, যার যেমন ইচ্ছা তাবলীগ জামাতে শামিল হয়ে আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন।
তাবলীগ জামাতের এসব নিরলস কর্মী কাফেলা বেঁধে মসজিদ থেকে মসজিদে সফর করেন। তারা লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবিনয়ে আল্লাহর পথে উদাত্ত আহ্বান জানান। তারা নামাজ কায়েমের কথা বলেন, আল্লাহর প্রেমের কথা বলেন এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলেন।
বাংলাদেশে শুধু নয়- আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ প্রায় প্রত্যেক মহাদেশেই তাবলীগ অনুসারীদের এ দ্বীনি দাওয়াতের কার্যক্রম মুসলমানদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী তাবলীগ জামাতের দ্বীনী কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও বিশ্ববরেণ্য অনেক আলেম-উলামা, ইসলামী ধর্মবেত্তা বিশ্ব ইজতেমায় শরিক হয়ে ইসলামের চিরশাশ্বত মর্মবাণী বয়ান করেন এবং আল্লাহর পথে পরিচালিত হয়ে মানুষকে আদর্শ সমাজ গঠনের আহ্বান জানান।
পৃথিবীর বহু দেশ থেকে মুসলমানগণ উপমহাদেশের তিনটি দেশে প্রায়শ তাবলীগী জ্ঞানার্জন ও বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য আগমন করেন। আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বানের যে নিরন্তর প্রচেষ্টা, যে গভীর আন্তরিকতা এর একটি প্রাণবন্ত ও বিপুল বহিঃপ্রকাশ এই বিশ্ব ইজতেমা। যে লোক কখনো কোরআন শরিফ পাঠ করেনি, একটি সূরাও যার জানা নেই, নামাজ কিভাবে আদায় করতে হয় তাও যার অজানা, সেরকম একজন নিরক্ষর মানুষের পক্ষেও তাবলীগ জামাতে শামিল হয়ে দ্বীনদার হয়ে ওঠা মোটেও কঠিন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে এমন অনেক মুসলমান আছেন, যারা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে সত্যিকারের পরহেজগারি অর্জন করেছেন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছেন।
ইসলামী দাওয়াহ ও তাবলীগের লক্ষ্য হচ্ছে ‘ঈমানের আন্দোলন’- এটি আত্মসংশোধন তথা সমগ্র মানবজাতির মুক্তির আন্দোলন। ঈমানের আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ প্রদত্ত জীবন, সম্পদ এবং সময় আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে এর সঠিক ব্যবহার শিক্ষা করা এবং বাস্তব জীবনে এর সঠিক প্রয়োগ করার পাশাপাশি স্রষ্টাভোলা মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করে দেওয়ার মেহনত করা। মানব জীবনে দাওয়াহ ও তাবলীগের ঈমানের আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ মানুষ আজ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অনুসৃত পথ ভুলে এমন বিপথ অনুসরণ করছে, যা মানুষকে জান্নাতের পথ থেকে দূরে সরিয়ে জাহান্নামের পথের দিকে ধাবিত করছে।
দাওয়াত ও তাবলীগ দ্বারা মানুষের ঈমান মজবুত হয়ে যায়। এ মজবুত ঈমান মানুষকে মদ খাওয়া, সুদ-ঘুষ দেওয়া-নেওয়া, মালে ভেজাল দেওয়া, অসত্ উপায়ে অর্থ উপার্জনের হীন মানসিকতাকে ফিরিয়ে রাখে। মানুষ যখন আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে কষ্ট আর মুজাহাদার সঙ্গে দ্বীন শিক্ষা করতে থাকে, তখন তার ভেতরের আমি নামক অস্তিত্বটা আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে থাকে। আর যখনই মানুষ আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে থাকে, তখন সে আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতার সামনে নিজের অস্তিত্বের সর্বস্ব লুটিয়ে দেয়।
নিজের দম্ভ আর অহমিকা যখন মিটতে শুরু করে তখনই মানুষের ভেতরের পশুত্বের মৃত্যুর পাশাপাশি মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। মানুষ ভালো ও মন্দের মধ্যে প্রভেদ করতে শেখে। নফসের গোলামির শৃংখল ছিন্ন করে এক আল্লাহর দাসত্বকে মেনে নেয় আর বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণে জীবন গঠন করে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।
ইসলাহে নফসের চারটি অংশ ও চারটি পদ্ধতি রয়েছে যা তাবলীগ জামাতে রয়েছে। ‘সত্ লোকের সান্নিধ্য, জিকির ও ফিকির, আল্লাহর জন্য ভ্রাতৃত্ব বন্ধন এবং আত্মসমালোচনা’ – এ চারটি জিনিসের সমষ্টিই হল তাবলীগ জামাত। সাধারণ মানুষের ইসলাহে নফসের জন্য এর চেয়ে উত্তম কোনো পথ হতে পারে না।
তাই তাবলীগের এ অরাজনৈতিক আন্দোলন আশাতীত সার্থক ও সফল বলে বিবেচিত; যা পরিচালনার জন্যে গড়ে উঠেছে একটি সুশৃংখল সুবিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামো, তৈরী করেছে নিয়মিত ও নিবেদিতপ্রাণ বিপুলসংখ্যক প্রচারক বা মুসল্লিগ। তাবলীগ জামাতের বিশেষ কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত ইজতেমা বা সম্মেলনের আয়োজন। তন্মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো টঙ্গীর বার্ষিক বিশ্ব ইজতেমা। এ ইজতেমা শুধু তাবলীগ জামাতের কার্যক্রমের প্রসারের ক্ষেত্রেই নয়; বরং বাংলাদেশের জাতীয় জীবনেও এটি দিন দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তর সমবেত মুসল্লিদের ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকারে এক পুণ্যভূমির রূূপ ধারণ করে। তাই অনেকে আবেগকে চেপে রাখতে না পেরে বিশ্ব ইজতেমাকে হজ্বের সাথে তুলনা করে বসেন এটা কোনো মতেই শোভনীয় নয়। তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমাকে হজ্বের সাথে তুলনা করা ঘোরতর অন্যায়। কারণ হজ্ব হলো ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি অন্যতম ফরজ ইবাদত। যা না করলে গুনাহগার হতে হয়। কিন্তু তাবলীগের ইজতেমায় আসা ফরজ নয় এবং না আসলে গুনাহগারও হতে হবে না। দুটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার একটির সাথে অন্যটির কখনোই তুলনা করা চলে না।
হজ্বের মত লোক সমাগম হলেই সেটাকে দ্বিতীয় হজ্ব বলা কোনোমতেই সমীচীন নয়। সময়ের ব্যবধানে বিশ্ব ইজতেমায় মানুষের উপস্থিতি যেমন বেড়েছে, তেমনি এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আমাদের দেশের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব কম-বেশী অনুভূত হচ্ছে। মুসলিম ধর্মীয় জাগরণের ক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
লেখক: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ,
দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমণ্ডি, ঢাকা।
তাবরীগের ক্ষেত্রে প্রচলিত যেই নিয়ম আছে
যেমন তিন দিন/চল্লিশ দিন/এক চিল্লা।
এভাবে দিন নির্ধারণ করা এবং মসজিদে গাট্টি নিয়ে যাওয়া এটা কি বিদআত নয়???