আত্মোন্নয়নে নতুন বছরে নিন ১২ পরিকল্পনা

মাওলানা মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ 

হায়াতের মূল্যবান একটি বছর শেষ হয়ে যায়, নতুন বছর আসে। সফলতা অথবা ব্যর্থতার একেকটি দিন শিশির ফোটার মতো টুপ টুপ ঝরতে থাকে। এভাবে সপ্তাহ, মাসের পর বছর শেষে আসে আরেকটি বছর। আজ ও আগামী, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল সময় এভাবেই অতীতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু, আমরা চাইলে সুন্দর, বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সময়গুলোকে এ জীবন ও অনন্ত সেই জীবনের জন্য পূঁজি করে নিতে পারি।

আমরা প্রত্যেকেই চাই হতাশা, ভুল, গ্লানি আর কষ্টগুলো ছেড়ে নতুন করে বাঁচতে। আমরা বহু মানুষ এর পরিকল্পনাও করি, ছক একে রুটিন প্রস্তুত করি, নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা নেই। কিন্তু আমরা সবাই কি সফল হতে পারি?

পরিসংখ্যান বলে, শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ রুটিন অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়, ফলে অনেকেই আরও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। অথচ একজন মুসলিমের প্রতিটি দিন আগের দিনের চাইতে সুন্দর হবে, এটা হাদীসের কথা। আবার হতাশা মুমিনের বিশ্বাস ও আদর্শের পরিপন্থী। তাই চলুন, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নতুন বছরের কিছু মৌলিক পরিকল্পনা গুছিয়ে ফেলি।

প্রথমেই পরকালমুখী পরিকল্পনা :

১। প্রতিদিন কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন

প্রতিদিন অন্তত দশ মিনিট হলেও বুঝে বুঝে কুরআন পড়বো। মোবাইলেও ডাউনলোড করে নিতে পারি পবিত্র কুরআন। এতে করে চলাফেরায়, কাজের ফাঁকে প্রিয় আয়াতগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাবে। অন্তত নামাযে বেশি পড়া সূরাগুলোর অর্থ আমাদের বুঝে শিখে নেওয়া উচিত। কোন পছন্দের কারী, যার তিলাওয়াত আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, নিয়ম করে শুনতে পারেন।

রাতে ঘুমের আগে নিজে বা উত্তম হয় পরিবারের সবাইকে নিয়ে দুটো হাদীস পড়ার অভ্যাস করে নেওয়া। এক্ষেত্রে নির্বাচিত হাদিসের সংকলিত গ্রন্থ ‘রিয়াদুন সালেহীন’ বা ‘মুন্তাখাব হাদিস’ আপনার জন্য উত্তম বিবেচিত হতে পারে। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য বড় হাদিসগ্রন্থগুলো পড়তে চাইলে উচিত হবে কোন অভিজ্ঞ আলেমের তত্ত্বাবধান গ্রহণ করা।

২। যথা সময়ে নামায আদায় এবং রবের সাথে নিবিড় সখ্যতা

যথা সময়ে ও খুশু খুজুর সাথে নামায আদায়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা মুমিনের সফলতাকে নামাযে খুশু বা একাগ্রচিত্ত হওয়ার সাথেও সম্পর্কযুক্ত করেছেন। একটি কবুল নামাযের জন্য একাগ্রতা খুবই জরুরী। আর, সপ্তাহে অন্তত একদিন তাহাজ্জুদে নিবিড় আলাপন হোক আপনার রবের সাথে। গভীর রাতে, নিভৃতে আবেগ ঢেলে দিয়ে বলুন যতো দুর্বলতা ও অক্ষমতার কথাগুলো।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “বস্তুতঃ আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যপারে, বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেনো আমার হুকুম মান্য করে এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। যাতে তারা সৎ পথে আসতে পারে।” -সুরা বাকারা:১৮৬

৩। ছুটির দিনে আরবী ভাষা শেখা

কুরআনের ভাষা আরবী। এই আরবী ভাষা সুন্দরভাবে শিখা ও শিখানো হোক এই বছরের অন্যতম কাজ। এছাড়া দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ছুটির দিনের একটি আংশ আমরা কাজে লাগাতে পারি।

৪। সপ্তাহে একদিন দূরের কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের খোঁজ নেওয়া

অবাধ সামাজিক যোগাযোগের এ যুগে আমরা আরও বিচ্ছিন্ন ও আত্মমুখী হয়ে পড়েছি। এটা দুঃখজনক। সপ্তাহে অন্তত একদিন কোন আত্মীয় বা কোনো অসহায় ব্যক্তির খোঁজ নেওয়া, অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে বা সুন্দর পরামর্শ দিয়ে হলেও কোনো বিপদগ্রস্থের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সাপ্তাহিক কর্মপরিকল্পনার অংশ করে নিতে পারি। আমরা যদি এ কাজগুলো করি, আমাদের কাছে এর ফলাফল দ্বিগুণ হয়ে আসবে ইনশাআল্লাহ – এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি।

৫। যেখানেই থাকবো আদর্শ হবো

ছাত্র হলে ভালো ছাত্র, কর্মজীবী বা চাকুরীজীবী হলে নিষ্ঠা, দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে কাজ করা। অর্থাৎ, যেখানেই থাকবো সেখানেই যেনো আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করি, ভালবাসা ও আন্তরিকতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকি। নবীজী (সা.) বলেছেন,

“তোমরাপ্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে।” –বুখারী

৬। মিথ্যা বর্জন করি

তাওরিয়া বা কৌশল করতে গিয়ে একসময় অনেক মুমিন মুসলিম ও অজান্তে মিথ্যার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। নতুন বছর হোক সত্যবাদীতার এক স্বচ্ছ বছর। নিজের কাজের স্বচ্ছতা আপনাকে পরম শান্তিতে অবগাহন করাবে রোজ রোজ।

দুনিয়ামুখী পরিকল্পনা:

১। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ

প্রথমেই আপনার আগ্রহ অনুযায়ী লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে কাজ করা সহজ হয়। ইহকালীন জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে কোন মানুষই শতভাগ নিখুঁত না। নিজের ইতিবাচক শক্তি ও সক্ষমতার জায়গাগুলো খুঁজে বের করুন। প্রতিনিয়ত এর আরও উন্নয়নের চেষ্টা করুন। পরিকল্পনা সামনে রেখে লক্ষ্য অর্জনের কাজগুলো ভাগ করে নিন। এবার প্রতিদিন নীরবে কাজগুলো করে যান।

২। বাস্তবমুখী পরিকল্পনা

অতি উচ্চভিলাষী কর্মপরিকল্পনা না মানতে পারার অন্যতম কারণ। আপনাকে আপনি ভালোভাবেই চেনেন, আপনার সামর্থ্যের ওজন আপনি মেপেছেন নিশ্চয়? পারিবারিক, সামাজিক দায় দায়িত্বের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। সহজ করে রুটিন করুন। নিজের উপর যুলুম করবেন না । আর হাদীসেই বলা হয়েছে-

“যারা সহজের পরিবর্তে কঠিন কে গ্রহণ করেছে, তারা ধ্বংস হোক, এই কথা তিনি তিনবার বললেন।” – রিয়াদুস সালেহীন, ১৪৪

৩। পর্যালোচনা ও পুরস্কার

বারো মাসের পরিকল্পনা করে সেগুলো প্রতি তিন মাসে ভাগ করুন। প্রতি তিনমাসের প্রধান কাজ সচরাচর দেখা যায় এমন জায়গায় আর্ট পেপারে লিখে টানিয়ে রাখুন। মাস শেষে পর্যালোচনা করতে ভুলবেন না। পারসেন্টিজ হিসাব করুন। পরের মাসে বাকী কাজগুলো করুন এবং পারসেন্টিজ বাড়াতে পারলে নিজেকে ছোট্ট কোনো ট্রিট দিন।

৪। গঠনমূলক কাজে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার

পরিসংখ্যান বলছে- চিন্তা, গঠনমূলক কাজ ও একনিষ্ঠ সৃজনশীলতা চর্চায় বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বাঁধা হলো- সোস্যাল মিডিয়া। পূর্ণ মনোযোগী হয়ে কোনো কাজ করলে সেখানে বরকত থাকে। ইসমাইল কামাদির তাঁর বিখ্যাত বই টাইম ম্যানেজমেন্টে বলেন,

“কারো কল্যাণ করতে চাইলে তাকে এককভাবে কিছু সময় দিন, শুধু অকারণ হ্যাই হ্যালো কল্যাণকর কোনো কাজ না। একজন মুসলমানের মন খারাপ বা অযথা কোনো কাজ করার সময় থাকা উচিত না!”

সোশ্যাল মিডিয়া যেনো আমাদের আসক্তি না হয়ে যায়। সপ্তাহে অন্তত একদিন এই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পূর্ণ বিরতিতে থাকা উচিত, এ দিনটিতে আপনি সশরীরে কোন আত্মীয়ের খোঁজ নিয়ে আসতে পারেন।

৫। ভ্রমণ ও পড়া

পৃথিবীর ১৯৫ টি দেশে আছে হাজারো আচার-সংস্কৃতির মানুষ। সময় সুযোগ পেলে অভিজ্ঞতা অর্জনে ও নিজের ক্ষুদ্রতাকে অনুভব করতে এই বিশাল পৃথিবীতে ভ্রমণ করা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা যমিনে ভ্রমণ করো, দেখো অস্বীকারকারীদের পরিণতি কি ছিল।” –সূরা আনআম:১১

আর, প্রতিমাসে অন্তত তিনটি বই বুঝে পড়া উচিত। বারো মাসের পাঠ-পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে পারেন। পথে ঘাটে জ্যামের সময়গুলোতে অনায়াসে পড়ে ফেলা যায় অনেক অনেক বই। এই পাঠ অব্যাহত থাকলে প্রতি তিনমাস পর নিজের উন্নয়ন দেখে নিজেই পুলকিত হবেন ইনশাআল্লাহ।

৬। ভুলের পুনরাবৃত্তি না হোক

বিগত বছরের ভুলের পুনরাবৃত্তি যেনো না হয় সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। বুদ্ধিমানরা একই ভুল বার বার করে না। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, মুমিন একই গর্তে দুইবার দংশিত হয় না। ভুল থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো লিখে রাখা উচিত। মানুষ নিজের জীবন থেকেই সবচেয়ে বেশী শিখতে পারে। তাই একেকটা সমস্যা হয়ে উঠুক একেকটি সম্ভাবনা, ভুলের পুনরাবৃত্তি না হোক নতুন বছরে।

আল্লাহ আমাদের জীবনের সুন্দর সব ইচ্ছা ও পরিকল্পনাগুলোকে বাস্তবায়ন করার সুযোগ দান করুন। নতুন বছরে কাজকর্মে রহমত ও বরকত দান করুন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *