কেমন হওয়া উচিত আপনার দৈনন্দিন রমযানের রুটিন

মুফতী নূর মুহাম্মদ


রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রমযান এখন আমাদের একেবারে অতিসন্নিকটে। সাহাবায়ে কেরাম ও সলফে সালেহীন রমযান আসার মাসখানেক আগ থেকেই রমযানের প্রস্তুতি শুরু করতেন, যাতে রমযান আসার পর প্রস্তুতির কাজেই রমযান কেটে না যায়। আমাদেরও উচিত রমযানের জন্য আগ থেকেই প্রস্তুতি নেয়া।

রমযানের সময়গুলো যেন ইবাদত বন্দেগীতে কাটে, রমযানের সময়গুলোর যেন সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার হয়, এর জন্যে প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন নেযামুল আওকাত বা রুটিন থাকা চাই। রুটিনে কী কী কাজ থাকতে পারে, তার একটা নমুনা নীচে দেয়া হল।

১. শেষরাতে সাহরীর আগে তাহাজ্জুদ ও দুআর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।

২. শেষরাতে সাহরী খাওয়া। মাঝরাতে নয়। একেবারে শেষ সময়ের কাছাকাছি এসে সাহরী শেষ করা। সম্পূর্ণ ভরপেট সাহরী না খাওয়া, বরং সম্ভব হলে কিছুটা কম খাওয়ার চেষ্টা করা।

৩. সাহরীর পর দেরি না করে মসজিদে চলে আসা। ফজরের আযান হলে মনোযোগের সাথে অর্থের প্রতি খেয়াল করে আযান শোনা, জবাব দেওয়া এবং আযানের দুআ বলা। এরপর সুন্নত পড়ে সময় থাকলে দুআয় মশগুল থাকা। একথা সর্বদা খেয়াল রাখা যে, আযান-ইকামতের মাঝে দুআ কবুল হওয়ার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এর খুবই যত্ন নেওয়া।

৪. ফরযের একামত শুরু হলে একামতেরও উত্তর দেওয়া। এরপর খুবই খুশু খুযূর সাথে অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে হাজির নাযির জেনে, জীবনের শেষ নামায মনে করে, খুবই গুরুত্বের সাথে ফরয নামায আদায় করা।

৫. সালামের পর নামাযের স্থানেই বসে থাকা এবং তিনবার আসতাগফিরুল্লাহ বলে এই আমলগুলো করা :

ক. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর ১০ বার।

খ. আয়াতুল কুরসী ১ বার।

গ. তাসবীহে ফাতেমী অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার ৩৪ বার।

ঘ. এরপর মুনাজাত করা।

ঙ. এরপর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতসহ আযকারুস-সবাহ বা প্রাতঃকালীন দুআগুলো বলা।

চ. এরপর সম্ভব হলে কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা।

চ. এরপর সুবহানাল্লাহ ১০০ বার, আলহামদুলিল্লাহ ১০০ বার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ১০০ বার, আল্লাহু আকবার ১০০ বার, দুরূদ শরীফ ১০০ বার এবং এস্তেগফার ১০০ বার, সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম ১০০ বার। এভাবে তাসবীহ-তাহলীল, দুআ-মুনাজাত ও আমলে লেগে থাকা।

ছ. সূর্য উঠার দশ মিনিট পর দু’ দু’ করে চার রাকাত এশরাকের নামায পড়ে বাসায় ফিরা।

৬. ঘুম থেকে উঠে অফিসে, কাজে বা হাট-বাজারে যাওয়ার আগে কমপক্ষে চার রাকআত চাশতের নামায পড়ে নেওয়া।

৭. যাদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য কুরআন শিক্ষা করা, তিলাওয়াত করা, তিলাওয়াত শ্রবণ করা, নির্বাচিত তরজমা-তাফসীর পাঠ করা, মোটকথা কুরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকা।

৮. যোহরের আযানের আগেই উযূ-গোসল থেকে ফারেগ হয়ে মসজিদে চলে আসা। যোহরের সুন্নতের পর ফরযের আগ পর্যন্ত তিলাওয়াত, তাসবীহ ও দুআয় মগ্ন থাকা। নামাযের পর আবার তিলাওয়াতে মশগুল হওয়া। আসরের আগে পরিমাণমত বিশ্রাম নেওয়া। আলেমগণ বলেন, এই সময়ের নিদ্রা তারাবীর নামাযে তন্দ্রা ও ক্লান্তি থেকে হেফাযত করে।

৯. ঘুম থেকে উঠে উযূ-এস্তেঞ্জা থেকে ফারেগ হয়ে আসরের আযানের আগেই মসজিদে চলে আসা। আসরের চার রাকআত সুন্নত পড়ে দুআয় মশগুল থাকা।

১০. আসরের পর আবার তিলাওয়াত অথবা যিকিরে মনোনিবেশ করা। ফজরের পর যে যিকিরগুলোর কথা বলা হয়েছে, যেমন সুবহানাল্লাহ ১০০ বার, আলহামদুলিল্লাহ ১০০ বার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ১০০ বার, আল্লাহু আকবার ১০০ বার, এস্তেগফার ১০০ বার, সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবহানাল্লাহিল আযীম ১০০ বার, দুরূদ শরীফ ১০০ বার। এভাবে ইফতারের ১০/১৫ মিনিট আগ পর্যন্ত তিলাওয়াত বা যিকিরে মগ্ন থাকা। এরপর ইফতার সামনে নিয়ে ইফতারের সময় হওয়া পর্যন্ত দুআয় মশগুল থাকা। এরপর ইফতারের সময় হওয়ামাত্র দেরি না করে ইফতারের দুআ বলে ইফতার শুরু করা।

১১. পবিত্র রমযানকে কেন্দ্র করে সত্তর হাজার বার কালিমায়ে তায়্যিবার একটি নেসাব নিজের জন্য পড়ে রাখা যায়।

১৩. কী দিয়ে ইফতার করা? উত্তম হলো তাজা খেজুর, তা না হলে শুকনো খেজুর, তাও না হলে পানি। এরপর অন্য খাবার।

১৪. ইফতার তৃপ্তিসহ খাওয়া যায়। তবে একেবারে উদরপূর্তি করে না খাওয়া। যেন রোযার উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়। এবং এতটুকু সময় আগে ইফতার থেকে ফারেগ হওয়া যেন মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করে মসজিদে এসে তাকবীরে উলা ধরা যায়। বস্তুত সকল ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করলে কোনো সমস্যা হয় না। খাবারের অংশ মুখে থাকলে তা গিলে ফেললে নামায মাকরূহ হয়, আর চনাবুট পরিমাণ বড় হলে নামায ভেঙ্গে যায়।

১৫. মাগরিবের পর ছয় রাকাত আওয়াবীন পড়ে সন্ধ্যাকালীন দুআসমূহ আদায় করা। এরপর সম্ভব হলে কিছু সময় তিলাওয়াত করে এশার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

১৬. এশার নামাযে আসার আগে একটু ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যেন তারাবীতে কষ্ট না হয়। প্রয়োজনে কোনো পানীয় সাথে নিয়ে আসা যায়, যেন আট বা বার রাকাতের বিরতির পর হালকা কিছু খেয়ে নেওয়া যায়।

১৭. তারাবীর পর দেরি না করে যথাসম্ভব দ্রুত শোওয়া উচিত, যেন শেষরাতে উঠতে কষ্ট না হয়।

১৮. মাহে রমযানের দিনে-রাতে চলাফেরা, উঠাবসা এবং একটু সুযোগ পেলেই যিকির ও মনে মনে দুআর চেষ্টা করা।

১৯. সত্যিকারের রোযার জন্য কয়েকটি জিনিসের হেফাযত জরুরী। নযরের হেফাযত, যবানের হেফাযত, মনের চাহিদার হেফাযত।

২০. বাচ্চাদের মধ্যে যাদের পক্ষে রোযা রাখা সম্ভব তারা রোযাই রাখবে। বাকিরা যতটুকু রাখতে পারে ততটুকুই রাখার চেষ্টা করবে।


(লেখক: মুদাররিস, দারুল উলূম মাদানীনগর মাদরাসা, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ
খতীব, ধানমন্ডি জামে মসজিদ, ১ নর্থ সার্কুলার রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *