নেককার নারী, না জান্নাতি হুর: কে শ্রেষ্ঠ? – মাওলানা তারিক জামিল

হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন; দুনিয়ার নেককার মহিলাগণ উত্তম না জান্নাতের হুরগণ উত্তম, এ প্রশ্ন সৃষ্টি হল কেন? দুনিয়ার নারীদেরকে তো সৃষ্টি করা হয়েছে পচা মাটি দিয়ে, যাদের থেকে মলমূত্র বের হয়। পক্ষান্তরে জান্নাতের হুরদেরকে মেশকে আম্বর, জাফরান, কাপুর দ্বারা তৈরী করা হয়েছে। যারা দুনিয়ার মধ্যে নিজেদের আঙ্গুল বের করলে পুরো পৃথিবী সুঘ্রাণে ভরে যাবে। পৃথিবীকে মোহিত করে তুলবে তার সুবাস! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা? তবুও রাসুল সা. কে যখন জিজ্ঞাসা করা হল উভয়ের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? রাসুল সাঃ উত্তরে বললেন, হে উম্মে সালামা! দুনিয়ার নারীরাই উত্তম !!

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ সা. কেন? কীভাবে?? মহানবী সা. বললেন, তাদের নামাযের কারণে, রোযার কারণে। তারা আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত করার কারণে।

এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, উপরোক্ত হাদীসে নামায, রোযা ইত্যাদি উল্লেখ করার পর, ইবাদতের কথা বলার কী প্রয়োজন? আমরা কেবল নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিকে ইবাদত মনে করি অন্য কাজগুলোকে ইবাদত মনে করি না?

উত্তর হল, হাদীসের যেখানে ইবাদত শব্দটি উল্লেখ আছে সবক’টি জায়গায় অর্থ হবে যে, পুরা জিন্দেগী বন্দেগীতে পরিণত করা। আর তা হবে আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে।

সর্বোপরি তাদের নামায, রোযা, ইবাদত সবই হবে আল্লাহর জন্য।  বিনিময়ে আল্লাহ আল্লাহ পাক তাদের চেহারায় নূর দেবেন। তাদের অপরূপ শরীরে রেশম জুড়ে দেবেন। নিখাঁদ স্বর্ণের অলংকার সজ্জিত করবেন। সুঘ্রাণ বিস্তারকারী আংটি পরাবেন।

একবার বাইতুল্লাহ শরীফে দেখেছি উদ গাছ পুড়ে তার সুঘ্রাণ দেয়া হচ্ছে। আরবে এর খুব প্রচলন আছে যে, রাজা-বাদশাহদের মহলে আম্বর, উদ ও মিশক পুড়ে তার সুগন্ধি ধোঁয়া দেয়া হয়। এতে পুরা মহল সুবাসে মোহিত হয়ে যায়।

এমনিভাবে তাদের আংটি থেকে ছড়ানো স্নিগ্ধতায় পরিবেশ সুরভিত হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রিয় বন্ধু মানবকুলের সর্দার মুহাম্মদ সা. বলেন, তাদেরকে এমন আংটি দেয়া হবে, যা থেকে খুশবু ছড়াবে। সে আংটিগুলো হবে মতির।

জান্নাতের হুর ও দুনিয়ার নেককার পরহেজগার ঈমানদার নারীদের মধ্যে বিতর্ক হবে: হুরেরা বলবে,
“আমরা তোমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ, কারণ আমরা চিরদিন জীবিত থাকব, কখনও বার্ধক্যে উপনীত হইনি, হবও না। আমরা চির কৃতজ্ঞ, আমরা কখনও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো না। আমরা চির বন্ধু, স্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের কখনও বিচ্ছেদ হবে না”।

দুনিয়াবাসীদের মধ্যে উপরের চারটি দোষই রয়েছে; চাই পুরুষ হোক বা নারী। সকলের মধ্যেই আছে। আমরা দুনিয়াবাসী বুড়া হই, আপোষে আমাদের বিবাদ-বিসংবাদ হয়, আমাদের বিচ্ছেদও ঘটে, আর সকলের মৃত্যু ছাড়া তো কোন গতি নেই।

সবই সত্য, তবুও ঈমানদার জান্নাতী নারীগণ উত্তরে বলবে, আমরা নামায কায়েম করেছি, তোমরা নামায পড়োনি। আমরা সিয়াম পালন করেছি, তোমরা সিয়াম সাধনা করনি। আমরা অজু করেছি, তোমরা কখনও করোনি।

আমরা আল্লাহর নামে দান খায়রাত করেছি। তোমরা তো কখনও আল্লাহর পথে দান-খায়রাত করোনি। হযরত আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেন, সুতরাং ঈমানদার মহিলারাই বিজয়ী হবে!

হুরদের উপর বিজয়ী হল কেন? ঈমানের কারণে, তাকওয়া, তাকওয়াক্কুল সতীত্ব রক্ষা, পবিত্রতা রক্ষা করার ফলশ্রুতিতে। উল্লেখিত কারণেই আল্লাহ তা’য়ালা জান্নাতী নারীদের সম্মানবৃদ্ধি করে দিয়েছেন। আর সেসব হুরদেরকে জান্নাতী নারীদের খাদেমা বা চাকরানী বানিয়ে দিয়েছেন।

একজন আরবী কবি খুব সুন্দরভাবে এ ঘটনাকে নিজের কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন, যার ভাবার্থ নিম্নে উদ্ধৃত হল: হুরগণ বলবে, তোমরা তো দুনিয়ার সংকীর্ণতা অতিক্রম করেছ, কবরের অন্ধকার অতিক্রম করেছ, মাটির দেহকে মাটির সাথে মিশিয়ে এসেছ।

আর জান্নাতে আমাদের জন্ম, জান্নাতুল ফিরদাউস আমাদের বিচরণ ভূমি। চিরস্থায়ী রাজ-প্রাসাদ আমাদের আবাসস্থল।

কথার উত্তরে জান্নাতী নারী বলবে: আমার প্রভুই তো আমাদের মৃত্যু দিয়েছেন। তোমরা তো দাওনি। এজন্য আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি। আচ্ছা বলতাে দেখি, আমাদের পিতা কি আদম (আঃ) নন? যার সামনে সব ফেরেশতারা সেজদায় লুটে পড়েছিল।

আর আল্লাহ তা’য়ালাও এ অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করেছেন। আমাদের পিতাকে ফেরেশতাকুল সেজদা করেছে এ দৃশ্য সকলেই দেখেছে। রাত দুপুরে যখন আধার ছেয়ে যায়, তারকাগুলোর আলাে মন্দা হয়ে যায়, তখন চুপি চুপি উঠে জায়নামাজে দাঁড়ানো এবং আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানোর মজা যদি তোমরা বুঝতে?!!

কেউ দেখে না যখন আল্লাহই দেখেন শুধু। সে স্বাদ শুধু আমরাই বুঝি, রাতে উঠে আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোর মজা এক ধরনের, জান্নাতের মজা অন্য ধরনের। চুপি চুপি আল্লাহর নিকট কান্না-কাটির স্বাদ আর জান্নাতের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন, দু’টো এক নয়।

তোমরা সে স্বাদ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। আচ্ছা ইবাদত বন্দেগীর কথা যদি বাদও দেই, আমরা তো সে মাতৃজাতি যাদের উদর হয়ে নবী রাসুলদের আগমন, আমাদের কোলে আম্বিয়ায়ে কেরাম লালিত-পালিত হয়েছে।

আমরা তো আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর উম্মত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি। শুধু কি তাই? আল্লাহর প্রিয় নবী ও প্রিয় বন্ধুর ইহ জগতে পদার্পণ আমাদের মাধ্যমেই। আবার আমাদের কোলেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন।

বিতর্ক চলছে তাে চলছেই কিন্তু ফয়সালা দিবে কে? স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরশে আযীমের উপর থেকে ফয়সালা দেবেন স্বীয় প্রিয় ঈমানদার বান্দীর পক্ষে। সুবহানাল্লাহ!

এটাই হচ্ছে আমাদের জীবনের টার্গেট, আমরা ধীরে ধীরে আমাদের সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলছি। আমরা এ পৃথিবীতে কেউ থাকার জন্য আসিনি। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক ছেড়ে যেতেই হবে। চলে যেতে হবে পরকালে, আখেরাতে। এ দুনিয়া নশ্বর, আখেরাত অবিনশ্বর। এ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আখেরাত চিরস্থায়ী।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা! সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য ও রাসূলের অনুসরণ করাই হচ্ছে জান্নাতের পথ, জাহান্নাম থেকে মুক্তির পথ।

নারী ইই বা পুরুষ হই আমরা যদি আমাদের শরীরকে আল্লাহর হুকুম, রাসুল সা. এর তরীকা মত ব্যবহার করি, আল্লাহর নাফরমানীতে ব্যবহার না করি, রাসূলের তরিকার বাইরে পরিচালনা না করি, হাত দিয়ে যদি অন্যায় না করি, মুখ দিয়ে অন্যায় না বলি, পা দিয়ে নিষিদ্ধ পথে না চলি, কান দিয়ে অন্যায় না শুনি, চোখ দিয়ে অন্যায় না দেখি এবং মন-মস্তিষ্ক দিয়ে যদি নিষিদ্ধ কাজের পরিকল্পনা না করি, বরং আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের মতে ও রাসূলের পথে পরিচালনা করি তবে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। খুশী হবেন আল্লাহ এবং তার বিনিময়ে দেবেন চির-কাঙ্ক্ষিত জান্নাত। আল্লাহ্‌ আমাদের বোঝার তাউফিক দেন।

অনুবাদ – রোকন হারুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.