আল্লাহ আকার না নিরাকার? আল্লাহর কি হাত পা আছে?

মুফতি লুতফুর রহমান ফরায়েজী
————————————–

প্রথমে একটি হাদীস দেখে নেই:

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

تفكَّروا في كلِّ شيءٍ , ولا تتفكَّروا في اللهِ

তোমরা সব কিছু নিয়ে গবেষণা কর। কিন্তু আল্লাহর সত্ত্বা নিয়ে গবেষণা করো না।

ইমাম যুরকানী রহঃ বলেন, হাদীসটি হাসান লিগাইরিহী। [মুখতাসারুল মাকাসিদ, বর্ণনা নং-৩১৮]

 

আল্লাহর আকার নিরাকার ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা নিষেধ।  আল্লাহ তাআলা আছেন।  তিনি সকল কিছুর স্রষ্টা।  তার কাছেই আমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।  তিনিই রিজিকের মালিক। ইত্যাদি আকীদা রাখা আবশ্যক।

 

কিন্তু তিনি দেখতে কেমন? তার আকৃতি কেমন? ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। সালাফে সালেহীনগণ এসব বিষয়ে আলোচনা করাকে অপছন্দ করতেন। আমরাও এসব নিয়ে আলোচনা করাকে অপছন্দ করি।

তাই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকাই নিরাপদ বলে মনে করি।

 

যাদের মনের মাঝে ফিতনা রয়েছে। কেবল তারাই এসব মুতাশাবিহাত বিষয়ে কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করে থাকে।

 

কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে:

هُوَ الَّذِي أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ [٣:٧]

তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট,সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে,তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর,তারা বলেন: আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। {সূরা আলে ইমরান-৭}

 

তাই আল্লাহর সত্ত্বার আকার নিরাকার নিয়ে কথা বলা সম্পূর্ণই নিষিদ্ধ বিষয়। কারণ এসব মুতাশাবিহাত এর অন্তর্ভুক্ত। যার সঠিক অবস্থান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না।

আমরা আল্লাহর “হাত, পা, চেহারা” ইত্যাদি অর্থ প্রকাশক শব্দের উপর ঈমান আনি। কিন্তু এগুলোর অবস্থা কেমন? আকার আছে নাকি নেই? ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করি না। মন্তব্য করি না।

আমরা কুরআনে বর্ণিত গভীর জ্ঞানীদের কাতারে শামিল হতে চাই। এসবের বাহ্যিক অর্থ বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফিতনা বিস্তার করতে চাই না।

 

হাত পা ইত্যাদি থাকলে সেগুলোর আকার থাকতে হবে। এমনটি মাখলুকের জন্য জরুরী। আকার ছাড়া হাত পা হওয়া অসম্ভব। কিন্তু স্রষ্টার জন্যও কি তা জরুরী?

 

যদি বলা হয়, মাখলুক দৃশ্যমান হবার জন্য যেমন আকৃতি জরুরী। তেমনি খালেকের দৃশ্যমান হবার জন্যও আকৃতি জরুরী। তাহলে স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। সৃষ্টির জন্য যা আবশ্যক, স্রষ্টার জন্যও তা আবশ্যক করে ফেলা হচ্ছে।

অথচ স্রষ্টা সৃষ্টির মত নন। তিনি তার মতই। তিনি সৃষ্টির সাদৃশ্যতা গ্রহণ করেন না।

 

কুরআনে পরিষ্কার ঘোষিত হয়েছে:

فَاطِرُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا ۖ يَذْرَؤُكُمْ فِيهِ ۚ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ [٤٢:١١]

তিনি নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডলের স্রষ্টা। তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং চতুষ্পদ জন্তুদের মধ্য থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন। [সূরা শোরা-১১]

 

খেয়াল করুন! উক্ত আয়াতে করীমায় ঘোষণা করা হচ্ছে: মহান রব সকল কিছুর স্রষ্টা। তার মত কিছুই নেই। তিনি সব কিছু শুনেন ও দেখেন।

যদি বলা হয়, শোনা ও দেখার জন্য মাখলুকের মতই স্রষ্টারও তার শান অনুপাতে আকার বিশিষ্ট কান ও চোখ প্রয়োজন। তাহলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে তারতম্য রইল কোথায়?

উভয় তো একই হয়ে গেল।

 

যেমন আমরা বলি যে, আমরাও শুনতে পাই, আবার হাতিও শুনতে পায়। আমাদের শোনার জন্য যেমন কান প্রয়োজন। তেমনি হাতির শোনার জন্যও কান প্রয়োজন।

তবে পার্থক্য হল, আমাদের কান হল ছোট। আর হাতির কান হল তার মত। অর্থাৎ বড়।

 

তেমনি আমাদের শোনা ও দেখার জন্য কান ও চোখ প্রয়োজন। আবার স্রষ্টারও শোনাও দেখার জন্য কান ও চোখ প্রয়োজন [নাউজুবিল্লাহ]

ব্যাখ্যা করলাম, আমাদের কান ও চোখ আমাদের মত। আর স্রষ্টার কান ও চোখ তার শান মুতাবেক।

তাহলে খেয়াল করুন। উভয় উদাহরণ হুবহু মিলে যাচ্ছে।

উভয় ক্ষেত্রেই আমরা সমতায় চলে আসছি। অর্থাৎ স্রষ্টাও সৃষ্টি উভয়ের জন্যই একটি আকার বিশিষ্ট বস্তুর প্রয়োজনীয়তাকে আবশ্যক করে নিচ্ছি।

তাহলে স্রষ্টা আর সৃষ্টির মাঝে পার্থক্য রইল কোথায়?

সৃষ্টির জন্য আকার প্রয়োজন, আবার স্রষ্টার জন্যও আকার সাব্যস্ত করলে আমরা তো স্রষ্টাকে সৃষ্টির মতই সাব্যস্ত করে ফেলছি। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিষ্কার ঘোষণা করলেন যে, তিনি মাখলুকের মত নন। তিনি সম্পূর্ণই আলাদা।

 

তাই আকার নিরাকার বিষয়ক আলোচনা করা থেকে সম্পূর্ণ রূপে বিরত থাকাই বুদ্ধিমান ও সুক্ষ্মদর্শী ঈমানদারদের দায়িত্ব।  আল্লাহ তাআলা অহেতুক আলোচনা করে ফিতনা সৃষ্টি করা থেকে আমাদের হিফাযত করুন। আমীন।

One thought on “আল্লাহ আকার না নিরাকার? আল্লাহর কি হাত পা আছে?

  1. জাল হানাফিরা দেখ,, আবু হানাফি রহঃ কি বলে? নাকি এখন হানাফি রহঃ কে ও দেখ বাদি বলবে? নাকি এখানে হানাফি মাযহাব তালাক দিছেন???আল্লাহ তায়ালার আকার সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ “তাঁর (আল্লাহর) হাত, মুখমন্ডল এবং নফস রয়েছে। যেমনভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁর মুখমন্ডল, হাত ও নফসের যে কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো তাঁর গুণ। কিন্তু কারো সাথে সেগুলোর সাদৃশ্য নেই। আর একথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর কুদরত বা নিয়ামত। কেননা এতে আল্লাহর গুণকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। আর এটা ক্বাদারিয়া ও মু’তাযিলাদের মত। বরং তাঁর হাত তাঁর গুণ, কারো হাতের সাথে সাদৃশ্য ব্যতীত। আর তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টি কারো রাগ ও সন্তুষ্টির সাথে সাদৃশ্য ব্যতীত আল্লাহর দুটি সিফাত”। [আল ফিকহুল আকবার, পৃষ্ঠা ৩০২]
    .
    ১২) ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ আরো বলেনঃ “আল্লাহর সত্তার ব্যাপারে কারো কথা বলা উচিত হবে না। বরং তাঁর সিফাতকে ঐভাবে বর্ণনা করতে হবে যেভাবে তিনি নিজের জন্য বর্ণনা করেছেন এবং আল্লাহর ব্যাপারে নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু বানিয়ে বাড়িয়ে বলা যাবে না। কেননা তিনি হচ্ছেন বারাকাতময় সবার ঊর্ধ্বে বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক”। [শরহে আক্বীদাহ আত ত্বহাবী, ২/৪৭২৭, তাহক্বীকঃ ড. তুরকী; জালাউল আইমাইন, পৃষ্ঠা ৩৬৮]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.