আল্লামা আহমদ শফী রহ.: এক নজরে সংক্ষিপ্ত জীবন

উবায়েদুল্লাহ তাসনিম।

স্মরণেই চিরকাল বেঁচে থাকবেন শায়খল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। যে আদর্শের পথ দিয়ে তিনি হেঁটেছেন, যে পথ তিনি দেখিয়েছেন সেই পথ ধরেই নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে। আমরা আল্লামা শাহ আহমদ শফী চেতনা, তার সততা, তার সাহসিকতা, রুচিশীলতা এবং মানসিকতাকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। নিজের পারিবারিক দারিদ্র্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করেও যিনি রাতারাতি অর্থশালী হওয়ার কথা ভাবেননি সেই মানুষটির নাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। আজ রাজধানীর আজগড় আলী হাসপাতালে ১৮-৯-২০২০ সন্ধ্যা ৬.২০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি সদালাপী, সত্যবাদী ও স্পষ্টভাষী। সব সময় নিচু স্বরে কথা বলেছেন। কটূ বাক্য উচ্চারণ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। তিনি দিয়েছেন জন্ম হাজার হাজার আলেম উলামা, তিনি হয়ে আছেন লক্ষ কোটি উলামায়ে কিরামের মধ্যমনি। সর্বোপরি তিনি হলেন একজন নিবেদিত আলেম শিক্ষক, দ্বীনের খাদেম। তার পথ ধরে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি জীবনব্যাপী কল্যাণকর কাজ করছেন, কোনো প্রাপ্তির আশা করেন নি। কোন লোভ, কোন মোহ , অনৈতিকতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি একজন নিরহংকার অথচ আত্মাভিমানী মানুষ। সম্মান হলো তার সম্পদ। মর্যাদা হলো তার অর্জন। তার ভাষা ছিল শুদ্ধ, উচ্চারণ ছিল গম্ভীর। তিনি উচ্চাভিলাসী ছিলেন না। কিন্তু দূরদর্শী ছিলেন। তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক।

দেশের উলামা-মাশায়েখদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত প্রবীণ এই আলেম, একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, হেফাজতে ইসলাম ছাড়াও উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে রয়েছেন। উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি দীর্ঘ দিন ধরে। বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এবং বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বেও তিনি রয়েছেন। শায়খুল ইসলাম হজরত মাওলানা হুসাইন আহদ মাদানী রাহ:-এর অন্যতম খলিফা আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী।

জন্ম ও শিক্ষা : তিনি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ১৩৫১ হিজরি সনে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে এক অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী দ্বীনদার আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। শরফভাটা মাদরাসায় প্রাথমিক কিতাব পাঠ করেন। এরপর আল জামিয়াতুল আরাবিয়া ইসলামিয়া জিরি মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে পাঁচ-ছয় মাস অধ্যয়ন করেন। ১৩৭১ হিজরিতে দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে ভর্তি হন। এখানে এসে তিনি একাধারে ১০ বছর কৃতিত্বের সাথে উর্দু, ফার্সি, আরবি ভাষা ও সাহিত্যসহ ইলমে নাহু, ইলমে সরফ, ইলমে ফিকাহ, মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), ফালসাফা (দর্শনবিদ্যা), বালাগাত (অলঙ্কারবিদ্যা) প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে সম হন।ওই বয়সে কিছুদিনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতা উভয়কে হারান। ওই সময় তিনি শায়খুল আরব ওয়াল আজম, সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানীর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। অল্প সময়েই তিনি খেলাফতপ্রাপ্ত হন।

দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে তিনি মিশকাত শরিফ, জালালাইন শরিফ ইত্যাদি কিতাব পড়া শেষ করেন। এরপর ইলমে হাদিস ও ইলমে তাফসিরের উচ্চতর শিক্ষা হাসিল করার অদম্য বাসনা নিয়ে ১৩৭১ হিজরি সালে ছুটে যান ইসলামি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র, দ্বীনি বিদ্যানিকেতন দারুল উলুম দেওবন্দে। দারুল উলুম দেওবন্দে হজরত ফুনুনাতে আলিয়া, দাওরায়ে হাদিস, দাওরায়ে তাফসিরের কোর্স অধ্যয়ন করেন।
দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি যাদের সংশ্রবে ধন্য হন, তাদের মাঝে প্রথমেই উল্লেখ্য শায়খুল আরব ওয়াল আযম, আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আল্লামা হুসাইন আহদ মাদানী রাহ:-এর নাম। দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই এই মহা মনীষীর হাতে বাইয়াত গ্রহণকরত খেলাফতপ্রাপ্ত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

কর্মজীবন : আল্লামা শাহ্‌ আহমদ শফী একাধারে চার বছর অধ্যয়ন ও বিশ্ববিখ্যাত ধর্মগুরুদের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে হাদিস, তাফসির, ফিকাহশাস্ত্র বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আল্লামা মাদানির প্রতিনিধি হয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন।

দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তার পরম হিতাকাক্সী ওস্তাদ জামিয়ার তৎকালীন মহাপরিচালক আল্লামা শাহ্ আবদুল ওয়াহ্হাব রাহ:-এর সাথে সাাতে মিলিত হন। আল্লামা আবদুল ওয়াহ্হাব রাহ: তার উচ্চরিত্র মাধুরী, অসংখ্য গুণাবলির দ্বারা ভূষিত জ্ঞান-প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, উৎকৃষ্ট বোধশক্তি, সততা, উদারতা, আত্মত্যাগ, ইখলাস ও দায়িত্ব সচেতনতা সর্বোপরি ইলমের গভীরতা অবলোকন করে অত্যন্ত বিমোহিত হন। ফলে অত্র জামিয়ার শীর্ষ পদে হজরতকে নিয়োগ দান করেন। ১৪০৭ হিজরি সালে তদানীন্তন জামিয়ার মহাপরিচালক হাফেজ কারি আল্লামা হামেদ রাহ: পরলোক গমন করলে জামিয়ার সর্বোচ্চ মজলিসে শূরার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামিয়া পরিচালনার গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয় শাহ্ আহদ শফীর ওপর।

তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষতায় যোগদান করেন এবং বিগত ২৭ বছর ধরে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের সাথে দীর্ঘ দিন যুক্ত থাকার কারণে সারা দেশে তার রয়েছে লাখ লাখ ছাত্র, মুরিদ, ভক্ত ও খলিফা। কওমি ধারার ৪০ হাজার মাদরাসার প্রায় প্রত্যেকটির শিক্ষকতা ও পরিচালকের পদে রয়েছে তার অগণিত ছাত্র। এ ছাড়াও তার শত শত খলিফা বা প্রতিনিধির মাধ্যমে আরো লাখ লাখ ভক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশের সর্বত্র এবং বহির্বিশ্বের অনেক স্থানেই। দেশের ওলামা-মাশায়েখ এবং ইসলামি রাজনীতির সাথে জড়িত শীর্ষ আলেমদের মধ্যে সমবয়সী দুই-একজন ছাড়া প্রায় সবাই তার ছাত্র, মুরিদ অথবা ভক্ত।

আন্দোলনে নেতৃত্ব : অনসৈলামিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ও ইসলামী প্রচারণার জন্য আল্লামা শফি ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গঠন করেন।

ভারতে বাবরী মসজিদ ধ্বংস, ফারাক্কা বাঁধ, তাসলিমা নাসরীন ইস্যু, সরকারের ফতোয়া বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তৎকালীন সময়ে আল্লামা শফি ছিলেন প্রথম সারিতে। ওই সময় মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সহ শীর্ষস্থানীয় আলেমদের নেতৃত্বে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন আন্দোলন করে।

গ্রন্থাবলী : উর্দু : ১. ফয়জুল জারী ২. আল-বায়ানুল ফাসিল বাইয়ানুল হক্ব ওয়াল বাতিল ৩. ইসলাম ও ছিয়াছাত ৪. ইজহারে হাকিকাত বাংলা : ১. হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব ২. ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ৩. ইসলাম ও রাজনীতি ৪. সত্যের দিকে করুন আহবান ৫. সুন্নাত ও বিদ’আতের সঠিক পরিচয়।

মৃত্যু: রাজধানীর আজগড় আলী হাসপাতালে ১৮-৯-২০২০ সন্ধ্যা ৬.২০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *