তাবলীগের বর্তমান সকল সমস্যার সমাধান ছয় উসূলের সঠিক চর্চার মাঝেই রয়েছে – মাওলানা আবদুল মালেক

তাবলিগ জামাতের বর্তমান সঙ্কট নিরসনের জন্য তাবলিগের ছয় উসূলের সঠিক চর্চা করাই যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ, মারকাযুদ দাওয়া আল ইসলামিয়া ঢাকা’র আমীনুত তালীম মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক সাহেব।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মিরপুর মারকাযে ( মিরপুর-১১ কেন্দ্রীয় মসজিদ) শবগুজারির বয়ানে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে তাবলিগ জামাতের হাল নিয়ে আমরা বড় পেরেশানিতে আছি। এই পেরেশানির সমাধান তাবলিগের ছয় উসূলের মধ্যেই (ছয় নাম্বার) আছে। এখনো যদি এই ছয় উসূলের সঠিক চর্চা করা হয় তাহলে এই ফেতনা শেষ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

তিনি বলেন, ছয় নাম্বারের প্রথম কথা হলে লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ বা কালিমা।  অর্খাৎ ঈমান ও আকিদা। অথচ আজকে আকিদার বিষয়টি আমাদের কাছে সস্তা হয়ে গেছে। যদি কারো আকিদার মধ্যে বক্রতা এসে যায়, কেউ যদি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে দুরে সরে যায়, তাহলে আমরা এটাকে হালকাভাবে দেখছি। এটাকে কোন বিষয়ই মনে করি না। অথচ এটা অনেক মারাত্নক একটা বিষয়।

কালিমার ব্যখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কালিমার দুটি অংশ। প্রথম অংশ লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ তথা আল্লাহর একত্ববাদের কথা। আর দিতীয় অংশ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ তথা রিসালাতের কথা। অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ নবী। তার উপর অবতীরর্ণ কিতাব সর্বশেষ কিতাব। তার আনিত শরিয়ত ও সুন্নাতের মধ্যেই হেদায়াত। এই শরীয়াত ও সুন্নাত থেকে কেউ বিমুখ হলে হেদায়াতের আর কোনো উপায় নেই।

তিনি বলেন, আমরা মনে করি কালিমার অর্থ হলো ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই’ শুধু এতটুকুই। তিনি বলেন, এর অর্থ শুধু এতটু্কুই নয় বরং আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, কোন রিযিকদাতা নাই, সন্তানদাতা নাই, তিনি ছাড়া ইবাদত পাওয়ার যোগ্য কেউ নাই ইত্যাদি-এই সবগুলোই কালিমার মর্ম।

দ্বিতীয় উসূল নামাজের আলোচনা করতে ‍গিয়ে তিনি বলেন, আমার নামাজ হচ্ছে কি না এটা বুঝার সহজ উপায় হলো আমার ২৪ ঘন্টার জীবন। আমার চলা-ফেরা, উঠা-বসা, লেন-দেন এগুলো যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে আমার নামাজ সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে। একজন নামাজ পড়ার পরও সুদ, ঘুষ, ‍যিনা, ব্যভিচার ইত্যাদি গুনাহর কাজ ছাড়তে পারল না তাহলে বুঝতে হবে তার নামাজ সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে না।

প্রথম কাতারে গিয়ে তাকবির উলার সাথে নামাজ পড়লাম, কিন্তু ঘরে গিয়েই স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করলাম বা গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে খারাপ ব্যবহার করলাম তো পরিষ্কার হয়ে গেল আমার নামাজ ভালভাবে আদায় হয়নি। আমার আচরণ চাল-চলন, ওঠা-বসা, এগুলো ঠিক করতে হবে। এগুলোর মেহনত ও নামাজের মেহনত একসাথে করতে হবে। যখন দেখব এগুলো ঠিক হচ্ছে না- বুঝবো নিশ্চয় আমার নামাজও ঠিকভাবে হচ্ছে না।

মুআমালাতের বিষয়ে তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন, উপার্জন যদি হালাল না হয়, যা উপার্জন করলাম তা যদি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যয় না হয়, তাহলেও বুঝতে হবে আমার নামাজ ঠিক হচ্ছে না। এরপর তিনি নামাজের ব্যপারে অবতীর্ণ কোরআনের প্রসিদ্ধ আয়াতটি উল্লেখ করেন। যাতে বলা হয়েছে, নামাজ নামাজিকে সমস্ত অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি হযরত শুয়াইব আ.-এর জাতির ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, তাদের অভ্যাস ছিল, তারা অন্যকে কোনো কিছু দেয়ার সময় মাপে কম দিত, আর নিজেরা নেয়ার সময় পরাপুরি নিত। এজন্য হযরত শুয়াইব আ. তাদেরকে এই কাজ থেকে নিষেধ করলে জবাবে সে যুগের কাফেররা বলেছিল, তোমার নামাজই কি এই আদেশ দেয় যে আমরা এগুলো ছেড়ে দেই?

তিনি বলেন, এর দারা বোঝা যায় যে, কাফেররাও এটা বুঝেছিল যে, নামাজের দাবি হলো মুআমালাত ঠিক হয়ে যাওয়া। সুতরাং নামাজ পড়ার পরও যাদের মুআমালাত ‍ঠিক হয়নি তাদের বুঝতে হবে যে, আমার নামাজ ঠিকমতো হচ্ছে না।

তৃতীয় উসূল ইলম ও ‍যিকিরের আলোচনা করতে ‍গিয়ে প্রজ্ঞাবান এই আলেমেদ্বীন বলেন, আমরা যারা তাবলিগে গিয়েছি তারা জানি যে, সেখানে বলা হয়, ইলম দুই প্রকার- মাসায়েলের ইলেম, ফাযায়েলের ইলেম। সেখানে এ-ও বলা হয় যে, ফাযায়েলের ইলম শিখবো তালিমের হালকায় আর মাসায়েলের ইলম শিখবো আলেম-ওলামদের কাছ থেকে। মাসায়েলের ইলমের মধ্যে সর্বপ্রথম হলো ঈমান তথা আকিদার মাসআলা। এগুলোও আমাদের আলেমদের কাছ থেকে শিখতে হবে।

কিন্তু বর্তমানে আমাদের অবস্থা হলো, আমরা মাসআলা শিখতেই চাই না। হঠাৎ কোনো একটা মাসআলা যদি সামনে এসেই যায়, তখন আলেমদের কাছে গেলেও আগে জিজ্ঞেস করতো, হুযুর সাল লাগিয়েছেন কি না। আর এখন জিজ্ঞেস করে, হুযুর সাদ সাহেবের অনুসারী কি না, সাদ সাহেবকে মানে কি না। যদি সাদওয়ালা হুযুর হয় তাহলে জিজ্ঞেস করব অন্যাথায় তার কাছ থেকে মাসআলা শেখা যাবে না।

তিনি বলেন, দ্বীনের মাসআলা সর্বদা আলেমদের কাছ থেকেই শিখতে হবে। ওই আলেম যদি সহীহ তরিকার উপর থাকে, তিনি তাবলিগে সময় লাগিয়েছেন কি না, সাদ সাহেবের অনুসারী কি না এটা দেখার দরকার নাই। বরং হক্কানী আলেম হলেই হবে।

দ্বীনী আলোচনার উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, দ্বীনী মুযাকারা করা, ঈমানের আলোচনা করা অনেক বড় নেক আমল। যদি সহীহ নিয়তে সহীহ কথাগুলো বলা হয়, তাহলে এই আলোচনা একজন মুমিনের ঈমানের ‍যিন্দেগিতে অনেক কল্যাণ ও সফলতা বয়ে আনবে।

যে মজলিসে আল্লাহর কুদরতের কথা আলোচনা করা হবে, তার বিধানের কথা আলোচনা করা হবে, আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করা হবে, দুরুদ-ইস্তেগফার পড়া হবে সবগুলো মজলিসই যিকিরের মজলিস হিসেবে গণ্য হবে। ঈমানের মজলিস হিসেবে গণ্য হবে। শর্ত হলো সহীহ নিয়তে হতে হবে, সহীহ কথা হতে হবে।

একটি ভুল ধারণা নিরসন করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাসবিহ পড়া, ইস্তেগফার করা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়াকেই আমরা শুধু যিকিরের মজলিস মনে করি। বিষয়টি এরকম নয়, বরং যেখানে ফাযায়েলে আমালের আলোচনা করা হচ্ছে, কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা হচ্ছে এগুলোও যিকিরের মজলিস, ঈমানের মজলিস। এর দ্বারাও ঈমান তাজা হয়।

কালিমার মর্ম যে ব্যপক একথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ হলো ঈমানের কালিমা। একে সূত্র ধরে যে আলোচনা করা হবে সবগুলেই ঈমানের আলোচনার মধ্যে গণ্য হবে। এর দ্বারা ঈমান তাজা হবে। সওয়াব হবে।

আল্লাহর কুদরত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত আল্লাহর হুকুম ছাড়া আমাদের কোনো কাজে আসবে না। আমরা ‍যদি এই পুরা দুনিয়ার মালিক হয়ে যাই তবু আমাদের কিছুই নেই। কারণ এই পৃথিবীটাই তো আল্লাহর। কোনো মানুষ অপর মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী হতে পারে, কিন্তু কেউ যদি পুরা দুনিয়ারও মালিক হয়ে যায় তবু সে বলতে পারবে না- আল্লাহর প্রতি আমি অমুখাপেক্ষী।

ঈমানকে নবায়ন করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাদীসে আছে, নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা ঈমানকে নবায়ন করতে থাকো। সাহাবীরা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঈমানকে কীভাবে নবায়ন করব? জবাবে নবীজি বললেন, বেশি বেশি লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ পড়ো।’ সুতরাং আমরাও বেশি বেশি এই কালিমার যিকির করব।

তিনি বলেন, ঈমান এমন জিনিস নয় যে, একবার মুখে পড়লাম এরপর মুখে তালা মেরে রেখে ‍দিলাম। ঈমান তো হলো শাজারাতুন তায়্যিবা বা একটি বৃক্ষ। গাছ লাগানোর পর যেমন তার যত্ন করতে হয় তেমনি ঈমান নামক গাছটিরও যত্ন করতে হবে। গাছের শাখা-প্রশাখা যেমন ছড়তে থাকে তেমনি অন্তরে যদি ঈমানের বৃক্ষ থাকে তাহলে আমলের শাখা-প্রশাখা বের হতে থাকে। তার পুরা অঙ্গ প্রতঙ্গ ‍দিয়ে ঈমান প্রকাশ পাবে।

আর এর জন্য ঈমানের মেহনত করতে হবে। ঈমানের মেহনত অনেক জরুরি। এটা এত সস্তা নয় যে কয়েকটা চিল্লা লাগালাম আর হয়ে গেল। চিল্লা লাগানোটা হলো ঈমানের মেহনতের অনেকগুলো পদ্ধতির একটা পদ্ধতির শুরু মাত্র। তবে এর জন্য আল্লাহর কাছে বশি বেশি দোয়াও করতে হবে।

বয়ানের শেষে তিনি উপস্থিত সাথীদের মাঝে তাশকিল করেন। কে কত দিনের জন্য তাবলিগে বের হবে-নাম লেখানোর আহ্বান জানান।

অডিও রেকর্ড থেকে সংক্ষেপন: মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version