নতুন শিক্ষকদের উদ্দেশে ১৭টি পরামর্শ (অভিজ্ঞতার আলোকে)

মাওলানা উসামা সিরাজ


শিক্ষকতা জীবনের আট বছর শেষ হল। প্রথম চার বছর মেশকাত পর্যন্ত কদীম নেসাবের দুটি মাদরাসায়, আর পরবর্তী চার বছর মাদানী নেসাবের একটি মাদরাসায়। আমার শিক্ষকতার এই আট বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে যারা শিক্ষকতার অঙ্গনে নতুন পা রাখতে যাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু আরজ করতে চাই।

১। মাদরাসায় শিক্ষকতার পেশাটা মিন ওয়াজহিন ইবাদত, মিন ওয়াজহিন মুআমালা। তাই নিয়োগের শুরুতেই আপনার সাথে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের যাবতীয় মুআমালাত তথা লেনদেনের বিষয়গুলো হাসিমুখে পরিষ্কার হয়ে নিন। শিক্ষকতার বাইরে মাদরাসার আনুসাঙ্গিক কোন দায়দায়িত্ব দিতে চাইলে তাও আলোচনার মাধ্যমে বুঝে নিন। আপনার প্রয়োজনীয় ছুটিছাটার বিষয়গুলো শুরুতেই সাফ করে নিন। তাছাড়া শিক্ষকতার বাইরে আনুসাঙ্গিক কোন পেশা যেমন, ইমামতি, লেখালেখি, টিউশনি ইত্যাদি গ্রহণের সুযোগ আছে কি-না তাও পরিষ্কার হয়ে নিন। এসব বিষয়ে অস্পষ্টতা রাখলে পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।

২। শিক্ষকতার শুরুতেই পারতপক্ষে দারুল ইকামার কোন দায়িত্ব নিতে যাবেন না। এটি আপনার শিক্ষকতার পেশাকে সূচনালগ্নেই বিষিয়ে তুলবে। কারণ দারুল ইকামার দায়িত্ব মানে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বিষয়ক দায়িত্ব। একজন নতুন শিক্ষক -যার এখন পর্যন্ত ছাত্রদের মাঝে কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি সৃষ্টি হয় নি- তার পক্ষে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং। তাছাড়া এ দায়িত্ব শুরু থেকেই ছাত্রদেরকে আপনার প্রতি আগ্রহী হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

৩। আশপাশের বিভিন্নজনের কথায় প্রভাবিত হয়ে শুরুথেকেই মাদরাসার মুহতামিম ও নাযেম সাহেবকে প্রতিপক্ষ ভাববেন না। তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গতভাবে আন্তরিক থাকুন। তাদের কোন সমস্যার কথা মাদরাসার অন্য কোন উস্তাদের সাথে সমালোচনা না করে আন্তরিকভাবে সংশোধনের নিয়তে সরাসরি তাদেরকেই জানান।

৪। আন্তরিকতা ও ইখলাস ব্যতীত কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতার পেশায় টিকে থাকা সম্ভব না। সবজায়গারই কিছু না কিছু সমস্যা-প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা আছে। যেমনটা আছে আপনি ব্যক্তির মাঝে এবং আপনার ঘর-সংসার ও পরিবারের মাঝে। সুতরাং এগুলো বুঝার চেষ্টা করবেন এবং আন্তরিকভাবে এগুলো সমাধান ও মুকাবেলার ফিকির করবেন। মনে রাখবেন, আপনি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিক হলে প্রতিষ্ঠানও আপনার প্রতি আন্তরিক হবে। পক্ষান্তরে আপনি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে প্রতিপক্ষ ভাবলে তারাও আপনাকে প্রতিপক্ষ ভাববে। এটাই স্বাভাবিক।

৫। প্রাথমিক অবস্থায় কখনই কর্তৃত্বপরায়ণ হতে যাবেন না। যোগ্য হলে আপনি এমনিতেই কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন।

৬। ছাত্রদের মাঝে নিজের জনপ্রিয়তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করবেন না। ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে আপনার জনপ্রিয়তা এমনিতেই সৃষ্টি হয়ে যাবে।

৭। ছাত্রদের মাঝে অন্যান্য শিক্ষকের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের চেষ্টা করবেন না। এতে আপনি প্রতিহিংসার শিকার হবেন।

৮। শিক্ষকদের কোন গ্রুপিং ও দলাদলির মাঝে যাবেন না। নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় থেকে নিজের মতো করে কাজ করে যাবেন।

৯। নিয়ম-কানুন, সুযোগ-সুবিধা ও ছাত্র সংখ্যা কোন বিষয়েই গ্রাম ও মফস্বলের ছোট পরিসরের মাদরাসাকে ঢাকা-চিটাগাংয়ের বড় বড় মাদরাসার সাথে তুলনা করতে যাবেন না। এতে আপনি বড় ধরনের হোঁচট খাবেন। প্রসিদ্ধ বড় বড় প্রতিটি মাদরাসা অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা ও সংগ্রাম করেই এ পর্যন্ত এসেছে। দারুল উলুম মাদানী নগরে এক সময় কাফিয়া, শরহে জামী জামাতে ৩-৫ জন করে ছাত্র ছিল।

১০। ছাত্রদেরকে ইকরাম করবেন, স্নেহ করবেন, প্রয়োজনে শাসন করবেন। কিন্তু তাদেরকে কখনই অপমান করতে যাবেন না। শাসন আর অপমান কখনও এক জিনিস না। একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে শাসন করতে পারে, কিন্তু কখনই অপমান করতে পারে না। ছাত্রদের থেকে অনাকাঙ্খিত বেশিরভাগ বেয়াদবির ঘটনা এই অপমানের কারণেই ঘটে। ছাত্রদের শাসন করবেন নিজের ছোট ভাইয়ের চোখে, নিজের সন্তানের চোখে দেখে।

১১। ছাত্রদের ইসলাহ-তরবিয়তের চেয়ে নিজের ইসলাহ-তরবিয়তের দিকে বেশি মনোযোগ দিবেন। কারণ ছাত্ররা উস্তাদের প্রতিবিম্ব বা ছায়ামাত্র।

১২। নিজের ছাত্র যামানার কথা ভুলে যাবেন না। ছাত্রদের অসংলগ্ন যেকোন আচরণকে বেয়াদবি মনে করবেন না। ছাত্রদের অনেক অশোভনীয় আচরণ বয়সের প্রভাবজনিত কারণে হয়ে থাকে। এতে উস্তাদের প্রতি বেয়াদবির কথা ঘূর্ণাক্ষরেও মাথায় থাকে না।

১৩। উস্তাদের প্রতি ছাত্রদের হকের চেয়ে ছাত্রদের প্রতি উস্তাদের হকের কথা মাথায় বেশি রাখবেন। ভুলে যাবেন না, ছাত্ররা উস্তাদের হক নষ্ট করলে যেমন উস্তাদের বদদোয়া লাগে, তেমনিভাবে ছাত্রদের হক নষ্ট করলেও উস্তাদের উপর ছাত্রদের বদদোয়া লাগে। বদদোয়া শুধু উস্তাদদের কোন একক পাওয়ার নয়। উস্তাদের বদদোয়ায় ছাত্রের জীবন হালাক হয়, আর ছাত্রদের বদদোয়ায় উস্তাদের সন্তানদের জীবন হালাক হয়ে যায়। [এদেশের অনেক বড় বড় আলেমের সন্তানরা কেন অমানুষ থেকে গেল এ থেকে বুঝে নিন।]

১৪। নিজের বিশেষ কোন প্রতিভা বা যোগ্যতা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সামনে তুলে ধরতে যাবেন না। হ্যাঁ, একান্ত প্রকাশ পেয়ে গেলে ইহসান ও ইনসাফের সমন্বয়ে সেটার বিনিয়োগ করবেন।

১৫। প্রতিষ্ঠানকে আপন মনে করে কাজ করবেন। যতদিন যেখানে থাকবেন ততদিন সেখানে তন-মন-ধন দিয়ে কাজ করবেন। নিছক চাকুরির মানসিকতা বাদ দিয়ে দ্বীনী যিম্মাদারী ও দ্বীনের খেদমতের মানসে কাজ করবেন। মাদরাসার তালাবা, আসাতেযা এবং দায়িত্বশীলদেরকে সবসময় দোয়ার মধ্যে স্মরণ রাখবেন। মাদরাসার তামাম যরুরিয়্যাত পূরণের জন্য দোয়া করবেন। মনে রাখবেন, আপনার রিজিকের ফায়সালা-বণ্টন সব আসমান থেকে হয়, যমিনে নয়।

১৬। কিতাবি কোন অস্পষ্টতা, দুর্বলতা দূরীকরণে পারতপক্ষে সহকর্মীদের সহযোগিতা না নিয়ে নিজের সহপাঠী বা উস্তাদদের সহযোগিতা গ্রহণ করবেন।

১৭। শিক্ষকতা জীবনের যেকোন সমস্যা ও ঝামেলা নিরসনে আপনার মুরুব্বি উস্তাদের শরণাপন্ন হোন, তাঁর পরামর্শ মুতাবেক কাজ করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *