মাহফুজা রহমান অমি
—————————————
‘বউমা, চপগুলো ভাজা শেষ?’
ডায়নিংরুম থেকে প্রশ্ন করলেন শাশুড়ি মা। আমি রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলাম, ‘জ্বী, মা। শেষ।’
‘পায়েসের কত দূর?’
‘এই তো মা প্রায় হয়ে আসছে।’
রান্নাঘরে আমি আর মর্জিনা রান্নাবান্নার কাজ করছি।
মর্জিনাকে দ্রুত কাজ কারার তাগাদা দিয়ে শাশুড়ি মা’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, তারা কখন আসবেন?’
‘ইফতারির আগেই চলে আসবেন।’
আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। বাড়িতে আজ মেহমান আসবে। শ্বশুরের খুব কাছের আত্মীয়। তাই আজ ইফতারি উপলক্ষে চলছে বিশাল আয়োজন৷
‘মাইশা একটু এদিকে আসো তো গাড়ির চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না।’
নাবিলের ডাকে তাড়াহুড়ো করে ছুটে গেলাম বেডরুমে। চাবিটা খুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘একটু বের হচ্ছি। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসব।’
আমি ‘আচ্ছা’ বলে আবার রান্নাঘরে চলে এলাম। নাবিলের সঙ্গে বিয়ের পর এটাই প্রথম রমজান। এ বাড়িতে প্রতিদিন ইফতারিতে হরেক রকমের খাবার দিয়ে টেবিল সাজানো থাকে। আমার তখন বাড়ির কথা মনে পড়ে।
শ্বশুর এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউমা, আমার জন্য তোমার হাতের ওই স্পেশাল সুজির পিঠাটা করেছো তো?’
আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, বাবা।’
কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধ সারা বাড়ি ছড়িয়ে গিয়েছে৷ শাশুড়ি মা এটা নিজ হাতে রান্না করেছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খেতে চমৎকার হবে। আমার ছোট ভাইটার কাচ্চি খুব পছন্দের। ওর কথা আজ খুব মনে পড়ছে।
শাশুড়ি মা আমাকে পছন্দ করে তার ছেলের বউ হিসেবে নিয়ে আসেন এ বাড়িতে। অর্থে বিত্তে এ বাড়ির ধারে কাছেও নয় আমার পরিবারের অবস্থান। ভালো সম্বন্ধ পেয়ে বাবা-মা মহাখুশিতেই বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
রান্নাবান্না পর্ব শেষ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই। আজকেও সুন্দর সব খাবারে ভরপুর থাকবে টেবিলটা। সবার সঙ্গে আমাকেও মজা করার ভান করে খেয়ে উঠতে হবে। এসব ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে আসে। দামি কোনো খাবার আমার পেটে হজম হতে চায় না। এসব খাবার মুখে তুলতেই বাড়ির সবার কথা মনে পড়ে। তারা কী খাচ্ছে, এই কথাটা ভাবতেই খিদে যেন পালিয়ে যায়। তবুও জোর করে খেয়ে উঠতে হয় আমাকে।
দরিদ্র পরিবারে খুব টানাটানির সংসারে বড় হয়েছি। অভাব ছিলো নিত্য দিনের সঙ্গী। ভালো খাবারের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও খাওয়া হত না। ভালো খাবারের পেছনে টাকা নষ্ট করার মতো যথেষ্ট টাকাটাও যে থাকতো না। খুব হিসেব করে চলা সংসারে অনেকদিন বাদে ভালো কিছু রান্না করতেন মা। সেদিন আমরা খুব আনন্দ নিয়ে খেতে বসতাম। বাকি দিনগুলোতে এত বেশি আনন্দ না থাকলেও অভিযোগ থাকতো না। কারণ এতেই তো অভ্যস্ত আমরা।
বিয়ের পরে এমন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছি না। অন্য সবকিছুর বেলায় মানিয়ে নিতে পারলেও খাবার সময়টা খুব অস্বস্তিতে কাটে আমার। রমজান মাস চলে আসতেই খাবারের আয়োজন আরও বেড়ে গেলো। আমার মানসিক কষ্টও বেড়ে গেলো। ছোট ভাইবোন আর বাবা মায়ের কথা মনে হতে থাকে খুব বেশি করে।
শাশুড়ি মা একদিন আমার প্লেটে মাছের বড় একটা মাথা তুলে দিয়ে বললেন, ‘এটা তুমি খাও।’
খেতে না চাইলেও আমাকে সেদিন খেতে হয়েছিলো। মাছের মাথা খাওয়া নিয়ে ভাই বোনদের মধ্যে কত ঝগড়া লাগতো, এসব মনে পড়তেই চোখের কোণে জল জমে গিয়েছিলো।
শ্বশুর জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী হয়েছে বউমা?’
আমি তখন তাড়াতাড়ি চোখের জল লুকিয়ে বলেছিলাম, ‘ঝালটা একটু বেশি হয়েছে বাবা।’
এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে আড়াল করে গিয়েছি ভেতরের অনুভূতি। এখানে ভালো থাকার সবকিছু থাকলেও আমি যেন ভালো থাকতে পারছি না৷
সেদিন ছোট বোনের সঙ্গে কথা হওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম ইফতারিতে মা কী কী তৈরি করেন।
বোনটা হেসে বললো, ‘ছোলা মুড়ি আর গুড় চিড়া।’
তারপর থেকে ইফতারিতে আমি ছোলা মুড়ি আর চিড়ার শরবত ছাড়া কিছুই তৃপ্তি সহকারে খেতে পারি না। গলা দিয়ে নামতে চায় না খাবারগুলো।
আজকে এত এত খাবারের মাঝে আবার আমাকে অস্বস্তিতে পড়তে হবে। তবুও সবার সঙ্গে হাসিমুখে খেয়ে উঠতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে ডায়নিংরুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। আযানের খুব বেশিক্ষণ বাকি নেই। টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে দিয়েছে মর্জিনা। ডায়নিংরুম ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াবো এমন সময় কলিংবেলের শব্দ। শাশুড়ি মা আমাকে দরজা খুলতে বললেন। আমি দরজা খুলতেই দেখি মা বাবা, ছোট বোন আর ভাইটা। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল।
আমি চেহারা জুড়ে আনন্দ নিয়ে বললাম, ‘তোমরা আসবে কই জানালে না তো!’
মা হাসলেন। বাবা বললেন, ‘না জানিয়ে এসে দেখলাম কেমন খুশি হোস তুই।’
শ্বশুর এসে হাসিমুখে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিন। আযানের খুব বেশি বাকি নেই।’
তাড়াহুড়ো করে সবাই ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লো। আমি শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, মেহমান আসার কথা তারা আসবেন না?’
শাশুড়ি মা হেসে বললেন, ‘মেহমান চলে এসেছে তো। আর কেউ আসার নেই।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে বললেন যে বাবার খুব কাছের আত্মীয়?’
শাশুড়ি মা হেসে উঠে বললেন, ‘তোমার পরিবারই তো আমাদের খুব কাছের আত্মীয়। তাই না?’
আমার মুখ জুড়ে খুশি আর চোখে চকচক করছে জল। আনন্দের জল নিয়েই সবাই মিলে ইফতারি করে নিলাম।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি। শাশুড়ি মা পাশে এসে দাঁড়ান। আমি তার দিকে তাকালাম।
তিনি লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘এ বাড়িতে যখন আমি বউ হয়ে আসি তখন আমিও তোমার মতো খেতে পারতাম না। খাবার যেন গলায় বেধে থাকতো। বাড়ির মানুষের কথা খুব মনে পড়তো।’
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘মা, আপনি আমার অনুভূতি বুঝতে পারতেন!’
‘আমারও যে তোমার মতো একটা পরিবার ছিলো৷ এই অনুভূতিগুলো যে আমার খুব চেনা, বুঝতে পারব না কেন!’
আমি চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার চোখে জল।
জল ভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘দুঃখের বিষয় হলো এ বাড়িতে আমার সেই অনুভূতির কোনো দাম ছিলো না৷ তোমার শ্বশুর আমাকে পছন্দ করে এ বাড়ি নিয়ে আসেনি। আমার শাশুড়ি আমাকে একদমই পছন্দ করতেন না। সংসারে তার উপরে কেউ কথা বলতো না। তোমার শ্বশুর আমার অনুভূতি বুঝলেও কখনো তার মায়ের উপরে কথা বলতে পারেনি।’
আমার চোখে ছলছল করছে জল। যেন তার কষ্টটা আমি অনুভব করছি খুব কাছ থেকে।
তিনি চোখের জল মুছে হেসে বললেন, ‘কিন্তু সুখের কথা হলো যে আমি অমন শাশুড়ি হতে চাইনি আর চাইও না।’
আমার ভেজা চোখে নিমিষেই আনন্দ ফিরে এলো।
শাশুড়ি মা আমার হাতটা ধরে বললেন, ‘যখন যেটা করলে ভেতরে স্বস্তি পাবে, ভালো থাকতে পারবে সেটাই করবে। আমি তোমার পাশে আছি৷ ভালো থাকার এত আয়োজনে তুমি খারাপ থাকো এটা আমি কখনো চাইব না।’
আমার ভেতরে শীতল এক হাওয়া বইছে৷ এতদিনের সমস্ত অস্বস্তি, খারাপ লাগা একটু একটু করে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে গেলেন আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছি, ভালো মানুষেরা বোধহয় এমনই হয়৷
ভালো লাগল,এ রকম গল্প আজকাল তেমন দেখা যায় না,অথচ এটাই জীবনের প্রকৃত অবস্থা
জাযাকাল্লাহ খাইর