রাত জাগলে কী কী সমস্যা হয়? দেরিতে ঘুমালে ক্ষতি কী?

মুফতি সাঈদ আল হাসান
প্রকাশক, মুফতি সাঈদ আল হাসান


জীবনে নানা প্রয়োজনে আমাদের প্রায় সবাইকে কখনও কখনও রাত জাগতে হয়। রাত জাগায় আপনি যদি অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন বা অসুবিধে মনে না করেন, তবুও এর বেশ কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে।

উত্তরটিকে সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও বিস্তারিতে ভাগ করা হয়েছে।

চলুন সংক্ষিপ্ত শিরোনাম জেনে নিই-

রাত জাগার ফলে শরীরের যে ১৩টি মারাত্মক ক্ষতি হয়:

১. উচ্চ রক্তচাপ শুরু হয়।

২. ওজন বাড়ে।

৩. ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমে।

৪. আয়ু কমে যায়!

৫. মানসিক অবসাদ বাড়ে।

৬. সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে।

৭. ত্বকের সৌন্দর্য হ্রাস পায়।

৮. হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হয়, অ্যাটাক হওয়াও অস্বাভাবিক না।

৯. মানসিক সমস্যার আশঙ্কা দেখা দেয়।

১০. চেহারায় মলিনতা বিরাজ করে, নিষ্প্রভ দেখায়।

১১. কর্মোদ্যমতা কমে যায়।

১২. রোগ প্রতিরোধে বাঁধার সৃষ্টি করে।

১৩. দেহ ঘড়িতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

 বিস্তারিত—

১.উচ্চ রক্তচাপ:

বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে টানা ২-৩ দিন রাতে ঠিক মত না ঘুমুলে শরীরের অন্দরে এমন কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে যে, তার প্রভাবে রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে। আর এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত যদি ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা না যায়, তাহলে শরীরের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

২.ওজন বাড়ে:

২০১৪ সালে হওয়া একটি স্টাডিতে দেখা গেছে টানা কয়েকদিন ৬ ঘণ্টার থেকে কম সময় ঘুমুলে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কারণ ঘুম কম হলে স্বাভাবিকভাবেই খিদে বাড়তে থাকে।

আর বেশি মাত্রায় খেলে যে স্বাভাবিকভাবেই ভাবে ওজন বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!? আর ওজন যখন মাত্রা ছাড়ায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই একে একে শরীরে এসে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের মতো নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ। তাই তো বলি বন্ধু, ওবেসিটির মতো মারণ পরিস্থিতির খপ্পরে পরতে যদি না চান, তাহলে রাত জাগার প্ল্যান বাদ দিতে হবে।

৩. ব্রেনের পাওয়ার কমে :

আমরা যখন ঘুমোই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক নিজেকে রিজুভিনেট ও রিচার্জ করতে থাকে। সেই সঙ্গে সারা দিন ধরে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এবং তথ্য ব্রেনে স্টোর করার কাজটাও এই সময় ঘটে থাকে। তাই তো ঠিক মতো ঘুম না হলে প্রথমেই স্মৃতিশক্তির উপর প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্গে কগনিটিভ ফাংশন কমে যাওয়ার কারণে মনোযোগ এবং বুদ্ধি কমে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলিও ঘটে থাকে।

প্রসঙ্গত, বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের কোনও কিছু শেখার ক্ষমতার সঙ্গে ঘুমের সরাসরি যোগ রয়েছে। তাই তো ঠিক মতো ঘুম না হলে এই ক্ষমতাও কমে যেতে শুরু করে। তাই সাবধান!

৪. আয়ু কমে :

প্রায় দশ হাজার ব্রিটিশ ছাত্রের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে যারা ৫ ঘণ্টা বা তার কম সময় ঘুমায়, তাদের হঠাৎ করে মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষদের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ঘুমের সঙ্গে হার্ট এবং ব্রেনের স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগ রয়েছে। তাই তো ঘুম ঠিক মতো না হলে শরীরেই সবথেকে দুটি ভাইটাল অঙ্গ দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে। আর এমনটা হতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই আয়ু চোখে পড়ার মতো কমে যায়।

৫. মানসিক অবসাদ :

২০০৫ সালে হওয়ার বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছিল দিনের পর দিন ঠিক মতো ঘুম না হলে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের অন্দরে ফিল গুড হরমোনের ক্ষরণ কমে যেতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটির মতো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তাই হাজারো চাপের মাঝেও মনকে যদি চাঙ্গা রাখতে চান, তাহলে ভুলেও ঘুমের সঙ্গে আপোস করবেন না যেন!

৬. সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে:

একাধিক কেস স্টাডিতে দেখা গেছে মাসের পর মাস ঠিক মতো ঘুম না হলে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশ এতটাই ক্লান্ত হয়ে পরে যে ঠিক মতো কাজ করে উঠতে পারে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কম সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। সেই সঙ্গে কেরিয়ারে দ্রুত উন্নতি করার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।

৭. ত্বকের সৌন্দর্য কমে:

দিনের পর দিন ঠিক মতো ঘুম না হলে কর্টিজল নামক স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যেতে শুরু করে। ফলে একদিকে যেমন মন-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যা, সেই সঙ্গে ত্বকের অন্দরে কোলাজেনের মাত্রা কমতে শুরু করার কারণে সৌন্দর্যও হ্রাস পায়।

৮. হার্টের মারাত্মক ক্ষতি হয়:

একাধিক গবেষণার পর এই বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই যে ঘুমের সঙ্গে হার্টের স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগ রয়েছে। সেই কারণেই তো চিকিৎসকেরা দৈনিক কম করে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আসলে এমনটা না করলে ধীরে ধীরে হার্ট দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে হার্ট ফেলিওর, ইরেগুলার হার্ট বিট সহ আরও নানাবিধ হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

৯. মানসিক সমস্যার আশঙ্কা দেখা দেয় :

গবেষণায় দেখা গেছে যারা প্রায়ই রাত জাগেন তাদের উদ্বিগ্নতা, অবসাদ ও বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এমনকি রাতে না ঘুমানোর সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতারও সম্পর্ক রয়েছে।

১০. চেহারায় মলিনতা বিরাজ করে :

এমনটা কি হয়েছে, নিয়মিত ত্বকের যত্ন নেওয়ার পরও ব্রণ বা চোখের চারপাশে কালো দাগ হচ্ছে। নিয়মিত রাত জাগা এর একটা কারণ হতে পারে। এই একই কারণে অকালে চেহারায় বয়সের ছাপ ও ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে।

১১. কর্মোদ্যমতা কমে যায় :

ডাক্তাররা বলেন, রাতে মানুষের ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। যেন দিনের বেলা দেহ ও মন কর্মক্ষম থাকতে পারে। ঘুমে অনিয়ম মানুষের কাজের উদ্যমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি রাতে ঘুম কম হলে মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়।

১২. রোগ প্রতিরোধে বাঁধার সৃষ্টি করে :

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত রাত জাগেন তাদের হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শারীরিক স্থূলতা এমনকি স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেশি থাকে। বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে মানুষ যতো বেশি রাত জাগে ততই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে।

১৩. দেহ ঘড়িতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় :

মানবদেহ তার অভ্যন্তরীণ নানা কাজ দেহের নিজস্ব সময় অনুযায়ী চলে। যেমন, রাত ২টায় মানুষের ঘুম সবচেয়ে গভীর অবস্থায় থাকে। রাত জাগার ফলে দেহের নিজস্ব ঘড়িতে বিশৃঙ্খলা ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।

আরও অনেকগুলি কারণ আছে। আজ আপাতত এইটুকুই থাক। কাজ হলে এইটুকুতেই হবে।

রাতের ঘুম দিনে হয়?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রাত জাগাকে কার্সিনোজেনের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। অর্থাৎ এটা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সার-বিষয়ক গবেষণা বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের তথ্য মতে, যখন সূর্যের আলো থাকে না, তখন শরীরকে কাজ করতে বাধ্য করা বা জাগিয়ে রাখা শরীরে মেলাটোনিন হরমোন তৈরিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। আর এই মেলাটোনিনই মানুষের দেহে টিউমারের বৃদ্ধিকে রোধ করে। ফলে তাদের ধারণা, রাত জাগা মানুষদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অর্থাৎ রাতের ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এটি কোনোভাবেই দিনের বেলায় ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেয়া যায় না।

ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্সের প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, যাদের ঘুমের নির্দিষ্ট সময় থাকে না অর্থাৎ যারা আজ রাত ৯টায় ঘুমায় তো কাল রাত ৩টায়, তারা অনেক বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। অনিয়মিত ঘুমের কারণে শরীরের এক-তৃতীয়াংশ জিনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগও হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ডায়াবেটিসের তথ্য মোতাবেক দুই লাখ আট হাজার তরুণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের বয়স ২০ বছরের কম। এজাজুর রহমান নামে এক তরুণ ডায়াবেটিস রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, এটি ধরা পড়ে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঘুম নিয়েই বেশি অনিয়ম করতেন বলে জানান তিনি।

অবশেষে বলা যায়, বিবর্তনগতভাবেই রাত মানুষের ঘুমানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তাই প্রকৃতির বিরুদ্ধে না যাওয়াতেই মঙ্গল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *